বই রিভিউ ও ডাউনলোড
তিয়াস ফারহানা রিভিউ – ইয়াসমিন
বইঃতিয়াস
লেখকঃফারহানা ইয়াসমিন
প্রকাশনাঃসতীর্থ
প্রচ্ছদঃসজল চৌধুরী
প্রকাশঃমার্চ ২০২১
মূদ্রিত মূল্যঃ৫০০ টাকা
একটা সংসার টিকিয়ে রাখতে কত শত ত্যাগ যে করতে হয় তা যারা করে তারাই জানে।একটা সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে হলে কত সার দিতে হবে সেটা নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে।আমার বাবা বলতো, সম্পর্কগুলো হলো একটা গাছের মতো।এই গাছের গোড়ায় তুমি যত সার দিবা গাছ তত পুষ্ট হবে।এখন কথা হলো সম্পর্ক গাছের পুষ্টি কী?
তিয়াস এ যেন এক তৃষ্ণার্তের আকুতি, কারো আকুতি নিজের স্বপ্ন পূরণের, কারো আকুতি ভালোবাসার,কারো আকুতি কাছের মানুষগুলোকে ভালো রাখার।কারো আবার তৃষ্ণা অর্থ,খ্যাতি, যশের।কবি নজরুলের লেখা একটা লাইন মনে পড়ে গেল এই প্রসঙ্গে,”আমি আকুল নিদাঘ তিয়াসা”।এই তিয়াস আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে আমাদের কি ধারণা আছে?মর্ত্যের মনুষ্য হয়ে পেতে পারি স্বর্গের স্বর্ণচূড়া অথবা গড়িয়ে পড়তে পারি পাতালের গহ্বরে।
উপন্যাসের জনরাঃ
উপন্যাসটি একটি সমকালীন রোমান্টিক উপন্যাস।এই উপন্যাসের পটভূমি তিয়াস নামধারী চরিত্রের জীবন আখ্যান।কিন্তু উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু তিয়াস হলে ও এই উপন্যাসে উঠে এসেছে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প,একটি সাধারণ দেখতে অসাধারণ মনের মেয়ের গল্প,শোবিজের তারকাদের সাফল্য-ব্যার্থতার গল্প।খ্যাতির শীর্ষে থেকে ও যাদের জীবনটা একলা, একাকীত্বের শিকার।
উপন্যাসটা রোমান্টিক কেননা তিয়াসের ব্যাক্তিজীবনের পাশাপাশি রেবতি নামে একটি মেয়ের প্রেমের আখ্যান ও লেখক সমানতালে লিখেছেন।
উপন্যাসের সারমর্মঃ
উপন্যাসে দেখা যায় মফস্বলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী সন্তান তিয়াস।স্বপ্নালু চোখের এই সুদর্শন যুবকটিকে তার খামখেয়ালীপনার জন্যই যেন মা বেশি ভালোবাসে।ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেয়েও যার কাছে মনে হয় নাটক তার প্রাণ, তাই সব ছেড়ে ছুড়ে নাট্যকলায় ভর্তি হয়।খালাতো ভাইয়ের সুবাদে পরিচয় হয় একটি সাধারণ মেয়ের সাথে। কিন্তু তিয়াস কি জানতো আলো আঁধারির মাঝে দেখা পাওয়া এই মেয়েটি তার জীবনের গার্ডিয়ান এঞ্জেল হয়ে দাঁড়াবে?……..
প্রিয় চরিত্রঃ
উপন্যাসের প্রতিটা চরিত্র লেখিকা এত মায়া দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে সব গুলোকেই ভালো লেগেছে।তাই সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবঃ
রেবতিঃবাহ্যিকভাবে সাধারণ দেখতে এক মেয়ে যার মনটা অনেক বড়।যার
চিন্তা ভাবনা অনেক পরিশালিত।বয়সন্ধিকালের ইনফেচুয়েশনে অনেকেই পড়ে, আর সেই ইনফেচুয়েশনের কবলে নিজের ভবিষ্যৎ না ভেবে অনেকেই ওলোট পালোট সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু নিজের কষ্টকে শক্তিতে খুব কম মানুষ রূপান্তরিত করতে পারে।
বন্ধুত্বে সবচেয়ে বড় জরুরি বিশ্বাস আর সত্যের উপস্থিথি।ভালোবাসার মানুষের প্রেমাস্পদের একান্ত মিলনের কথা শুনে ও নিজেকে অবিচল রেখে ভালোবাসার মানুষকে খুব কম মানুষ সামলাতে পারে।নিভে যাওয়া শিখাকে আবার নতুন করে বিকশিত করতে সাহসের পাশাপাশি মানসিক শক্তি ও লাগে।
নিজের প্রিয় মানুষের প্রয়োজনে যেমন বটগাছের মতো বিশাল ছায়া মেলে দিয়েছে তেমনি বাইরের ঝড়ের তান্ডব থেকে ও কি দারুণভাবে রক্ষা করেছে।
তিয়াসঃএক আলাভোলা ব্যোম ভোলানাথ।নিজের দুনিয়ায় বিভোর।কিন্তু মেনকা উর্বষীদের তান্ডবে ধ্যানভঙ্গ হলে শৃঙ্গাররসে মজে গেলেও এক সময় ঘোর ভাঙলে অনুতপ্ত হয়ে বটবৃক্ষের কাছে শান্তির পরশের ভরসায় আশায়।
জীবন সম্পর্কে উদাসীন হলেও ঢাকার জীবন তাকে পদপদে শিখিয়েছে জীবন কতোটা কঠিন,বাস্তব কতোটা রূঢ়।
তিয়াসের চরিত্রের সবচেয়ে ভালো লেগেছে নিজের ভালোবাসার জন্য যেমন সংগ্রামে নেমেছে তেমনি নিজের ভুল পাপ পূণ্যের খাতাও প্রেয়সীর কাছে তুলে ধরতে দ্বিধা করেনি।
গল্পের খুব দারুণ দুই চরিত্র ছিলো মোহসিনা বেগম আর আহসান সাহেব।একজন নারী হয়ে সন্তানদের মাথায় ভালোবাসার স্নেহময় ছায়া বিছিয়ে দিয়েছেন।আরেকজন সিঙ্গেল প্যারেন্ট হয়ে,বাবা মা দুজনের স্থান দখল করেছেন।রেবতির সবচেয়ে কঠিন সময়ে বন্ধুর মতো পাশে ছিলেন তাই হয়তো রেবু আজকের রেবতি হিয়ে উঠতে পেরেছে।
রাখী আর ফাহাদ ছিলো এই তিয়াস আর রেবতীর জীবনের North star.ওদের জীবনের ভুলগুলোকে শুধরে নিতে সাহায্য করেছে।
এই গল্পে সুহাসিনীকে সবাই ভিলেন মনে করলেও আমার কাছে ছিলো সবচেয়ে বড় প্রোটাগনিস্ট।যার প্রথম উপস্থিতি
তিয়াসের জীবনে আমি চমকে গিয়েছি।তেমনি এই চরিত্রের হাসি,কান্না,দুঃখ, রাগ,ক্ষোভ একজন পাঠক হিসেবে আন্দোলিত করেছে।
উপন্যাসের প্রিয় দিকঃ
গল্পে খুব সুন্দরভাবে লেখনীর মধ্যে দিয়ে কিছু জিনিস তুলে ধরেছেন,
১/গল্পের শুরুতে লেখক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের প্রতি বাবা মায়ের যে আশা আকাঙ্ক্ষা থাকে তার এক সুন্দর দৃশ্য অঙ্কন করেছেন।
২/নিজের স্বপ্ন পূরণে শত বাধা উপেক্ষা করে যাবার সাহস সবার থাকে না।
৩/সন্তানের এক হঠকারী সিদ্ধান্ত বাবার জন্য কতোটা উদ্বেগের তা প্রকাশ করেছেন তিয়াস আর তার বাবার সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে।
৪/গল্পের শুরুতে দেখা যায়,তিয়াস তার পিতাকে আব্বা বলে সম্বোধন করে, কিন্তু ঢাকায় বসবাস করার সময় যখন জীবন সংগ্রামে উন্নতির মুখ দেখা শুরু করলো তখন ছেলেকে appreciation প্রকাশ করতে তখন তিয়াস, আব্বা না বলে বাবা বলে সম্বোধন করে।এখানেই লেখিকা তিয়াসের আস্তে আস্তে পরিবারের দূরত্বের আভাস দিয়েছেন।
৫/প্রিয় মানুষের ভুলগুলো হাসিমুখে মেনে নেবার ক্ষমতা সবার থাকে না।কিন্তু সেই ভুলগুলো সুধরে প্রিয় মানুষকে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে দেয়াটা খুব কম মানুষ পারে।
৬/একজন মানুষের খারাপ আচরণ বা হিংস্র আচরণের পেছনে কিছু কারণ থাকে।আঘাত প্রাপ্ত বাঘই মানুষখেকো বাঘে পরিণত হয়।সেই আঘাতে মলম দেবার ইচ্ছা বা সামর্থ্য কি সবার থাকে?
প্রিয় লাইনঃ
১/স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে ফারাক বুঝতে হয় বুঝলে?এসব স্বপ্ন বড় লোকদের জন্য ঠিক আছে।আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জন্য এসব বিলাসিতা।লোকে শুনে হাসে, টিটকিরি করছে।আর এই সবে কি ওর পেট চলবে, সংসার চালাতে পারবে?
তিয়াসের বাবার মুখ দিয়ে উচ্চারিত এই কয়েক লাইনের মধ্যে দিয়ে আমাদের সমাজে চলমান এক ভ্রান্ত ধারণাকে লেখিকা আঙুল তুলে দেখিয়েছেন।ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবার ইঁদুর দৌড়ে সবাই এতই ব্যাতিব্যস্ত নিজস্ব সত্তা,ভালোলাগাটুকু ভুলে গেছি।নিজের প্যাশনটাকেই যদি পেশা বানিয়ে নেই তাহলে সাফল্য ধরা দেবেই।হয়তো পরিশ্রমটা বেশি হবে কিন্তু আত্বতৃপ্তি থাকবে।
২/সম্পর্কে গাছের পুষ্টি কী?আদর, মায়া, মমতা,ভালোবাসা,বিশ্বাস, ভরসা এগুলা হলো পুষ্টি।এগুলা যত দিবা তত বেশি পুষ্টি পেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হবে।
পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ
এ উপন্যাস পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে চরিত্রগুলা আমার সামনে সেলুলয়েডের পাতার মতো একের পর এক দৃশ্যায়ণ হচ্ছে।গল্পে একবারের জন্য আমার মস্থিস্ক,মন তিয়াস থেকে সরে যায় নি,একবার ও বিরক্তবোধ হয় নি।একের পর এক চরিত্রের আবির্ভাবে অন্য চরিত্রগুলোর সাথে চমৎকারভাবে মিলে গেছে।
এই উপন্যাস কোনো অলীক রূপকথা নয়,তিয়াসের জীবনের যে কাহিনী তা আমাদের আশেপাশের মানুষেরই ঘটনা।এ কোনো ফেইরি টেইল নয়,বাস্তব সত্যকে আঙুল তুলে চোখের সামনে দেখিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু সেই বাস্তবতার ছবি আঁকতে গিয়ে লেখিকা এক টুকরো আশার আলো হিসেবে রেবতিকে দেখিয়েছেন।
কাহিনীর যে Transition তা খুবই fluid ছিলো।পড়তে গিয়ে আসোয়াস্তি বা খটকা লাগে নি।
উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হয়েছে,
তিয়াসের past জানার পর রেবতি যেমন নিঃশঙ্কোচে সব মেনে নিয়েছেন তেমনি কি তিয়াসের স্থলে একটা মেয়ের এমন past history থাকলে কি একজন ছেলে সঙ্গী তা মেনে নিত?এই প্রশ্ন মাথায় আসতে আসতেই দেখি লেখিকা রেবতির মুখ দিয়েই এ প্রশ্ন করেছেন।সুহাসিনীর কষ্ট অনুধাবন করে ফাইয়াজ শুভ পুনরায় ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিলেও সুহাসিনীর সিদ্ধান্ত কি হবে তা আমাকে পরের পৃষ্ঠাগুলো আরো তাড়াতাড়ি পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে,আগ্রহী করেছে।
তিয়াস আর রেবতীর ব্যাক্তিগত মুহুর্তে লেখিকা খুব সহজেই অশালীন শব্দ ব্যবহার করতে পারতেন।sensuality আর vulgarity এর মাঝের সেই সূক্ষ্ম লাইন তিনি বজায় রেখেছেন দারুণভাবে।
মিডিয়া জগতের আলোকজ্জ্বল দুনিয়ার পেছনের অন্ধকার অধ্যায় যা casting couch সেই sensitive issue কে এত দারুণভাবে প্রকাশ করেছেন তা আসলেই প্রশংসনীয়।
তিয়াস উপন্যাসের ট্রাজিক পরিণতি মূল চরিত্রে না হলেও পার্শ্ববর্তী চরিত্রের শেষ পরিণতি পাঠক হৃদয়কে আন্দোলিত করেছে।
উপন্যাস পড়তে পড়তে আমার তিয়াস আর রেবতির চরিত্রে অনেকটা রবী ঠাকুরের শেষের কবিতার অমিত আর লাবণ্যের খানিকটা সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছি।গল্পের পরিণতি পাঠক হৃদয়ে এক সাথে হর্ষ বেদনার সঞ্চার করেছে।লেখনশৈলী আর গল্পের বুনন এত শক্তিশালী,একবার ও মনে হয় নি নতুন লেখিকার লেখা পড়ছি।
সমালোচনাঃ
বইটিতে সেরকম বড় ধরনের বৈসাদৃশ্য চোখে পড়ে নি তবে কিছু ছোট খাট বানান যেমন,
৭৬ পৃষ্ঠায় মাথা শব্দটি মাতা এসেছে।
৭৮ পৃষ্ঠায় আপুম্মু বলে মিফতাকে রেবু সম্বোধন করলেও ঐ প্যারাতেই আপুম্মু ডাক আর ব্যবহার না করে আপু বলে continue করেছে।
৭৯ পাতায় একটা লাইন, ছ্যতরানো কাজলে নাকি অন্যরকম সুন্দর দেখায় মেয়েদের,এই লাইনে ছ্যতরানোর জায়গায় অন্য শব্দ লেখিকা ব্যবহার করতে পারতেন।
তবে আনাফ আর তমার বিয়ের পটভূমি বা রেবতি তিয়াসের হানিমুন পিরিয়ডের একটু বর্ণনা পাঠককে আনন্দ দিত।
উপসংহারঃ
মায়ের সন্তান যেমন মায়ের চোখের তারা হয় তেমনি লেখিকার প্রথম বই তার সন্তানতুল্য।তাই সন্তানের সমালোচনায় মা যেমন কুন্ঠিত হয় তেমনি লেখিকা ও কষ্ট পায়।আর এই গল্পে সমালোচনার তেমন স্থান নেই।সতীর্থ নতুন প্রকাশনী হিসেবে দারুণ কাজ করেছে।এত চমৎকার এডিটিং, বাইন্ডিং আর নজরকাড়া প্রচ্ছদে পাঠককে বইটির প্রতি আর ও আগ্রহী করে তুলেছে।
কবিতার লাইন বা সুহাসিনীর চিঠির দারুণ ফন্টে মনে হয়েছে এই বইটি আসলেই প্রকাশনী অনেক যত্নে তৈরী করা।
বইটা পড়তে পড়তে আমি একই সাথে হর্ষ বিষাদের সাগরে অবগাহন করেছি,তাই পাঠক হিসেবে বইটা আমাকে দারুণ সময় উপহার দিয়েছে।