বই রিভিউ ও ডাউনলোড
আলোর ফেরিওয়ালা মুহাম্মদ বরকত আলী বই রিভিউ
বইয়ের নাম: আলোর ফেরিওয়ালা
লেখক: মুহাম্মদ বরকত আলী
প্রকাশনী: শব্দভূমি
প্রথম প্রকাশ: ২০২০
বইয়ের প্রচ্ছদ মূল্য: ২০০ টাকা
পৃষ্ঠা নং : ৮০
বইটির প্রথম পাতা খুললেই ভূমিকায় দেওয়া আছে, আশরাফ সিদ্দিকীর লেখা বিখ্যাত কবিতা “তালেব মাস্টার” কবিতার কিছু অংশ…
“আমি যেন সেই হতভাগ্য বাতিওয়ালা;আলো দিয়ে বেড়াই পথে পথে কিন্তুনিজের জীবন অন্ধকারমালা।”
কবিতার চরণগুলোর এত সুন্দর ব্যাখা দেওয়া আছে যে কেউ পড়লে প্রথমেই এখানেই কবির প্রেমে পড়ে যাবে! আমার বেলায় ও বেতিক্রম হয়নি..!
এবার আসি বইয়ের কথায়, “আলোর ফেরিওয়ালা” মুলত বইটি উপন্যাস বই, লেখক মুহাম্মদ বরকত আলী।
এখানে একটি ননএমপি ভুক্ত মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা বিনা বেতনে পড়িয়ে আসছেন, একদিন বেতন হবে এই আসায়।
লেখক পুরো গল্পজুরে তপু চরিত্রে ছিলেন, যে কোনো পাঠক পড়লে তপু চরিত্রেই নিজেকে আবিষ্কার করবেন।
যিনি একজন তরুণ শিক্ষক, তার হাবভাব সব আজব আজব রহস্যে ভরা। একদম সরল মনের মানুষ তিনি, সব ছাত্রদের সুখ দুঃখে তিনি এগিয়ে আসেন।
ছোটবড় সবার সাথে সবসময় হাসিখুশি কথা বলেন, বিভিন্ন কাল্পনিক কথা বলে সবাইকে চমকিয়ে দেন।
এজন্য অনেক ছাত্র শিক্ষক মাঝে মাঝে পাগল ভেবে বসেন।
সমচেয়ে মজার ব্যপার হলে ফরিদ স্যার কে তিনি ইচ্ছা করেই সাহেব বলে ক্ষেপিয়ে তুলেন।
এখানে ফরিদ স্যারের
চরিত্রে যিনি আছেন তিনি খুব পরিশ্রমী মানুষ, সব সময় নিজের কাজ গুলো সঠিক ভাবে করেন। সবার সাথে তেমন একটা কথা বলেন না, সারাক্ষণ লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নিজেকে সমাজের জন্য উৎসর্গ করেছেন।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো তাকে যদি কেউ ফরিদ সাহেব বলে ডাকে তবে বিষন রেগে যায়। তার মতে বিনা বেতনে চাকরি করা মানুষকে সাহেব বলা রিতিমত অপমান করা!
এনিয়ে লেখকের (তপু চরিত্রে) সাথে মাঝে মাঝে মজার তর্কবিতর্ক হয়।
এখানে আরো বেশ কয়েকটা চরিত্র আছে তার মধ্যে মৌসুমি হাসান আপাও অন্যতম, তিনি রোজ রোজ স্কুলে আসেন দেড়ি করে আর নানান রকম আজগুবি সব অযুহাত দেখান। উনার সাথে লেখকের মাঝে মাঝেই এটা ওটা নিয়ে কথার সৃষ্টি হয়। তিনি একটু মুখ ফসকো মহিলা, কাউকে কোনো কথা বলতে মুখে আটকায় না, আবার একটা কথা বলেই সাথে সাথেই গা বাঁচিয়ে নেয়, এনিয়ে বিনিয়ে এটা ওটা বলে কাটিয়ে দেয়। এচরিত্রের জন্যেও অন্য রকম একটা ভালো লাগে।
হেডস্যার চরিত্রে আছেন আখতারুজ্জামান স্যার, তিনি সবসময় বিভিন্ন চাপে থাকেন, স্কুলের নামে যত বাজেট আসে সব চলে যায় সভাপতির পকেটে মাঝখান থেকে সব দোষ হয় হেডস্যারের।
এখানে প্রধান চরিত্র যাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তিনি হলেন গাজী স্যার, তিনি দির্ঘদিন বিনা বেতনে পড়িয়ে আসছেন। শুধু তাই নয়, স্কুলের জন্য উল্টো নিজের টাকা খরচা করেছেন। বিনা বেতনে পড়ানোর কারনে তার এলাকার সবাই বোকা মাস্টার নামে ডাকতো। তার অবশ্য এনিয়ে কোনে মাথাব্যথা ছিলো না, তিনি বিনা বেতনে পড়াতেই আনন্দ পান। তবে মাঝে মাঝেই তার বন্ধুদের কাছে শুনেন উমুক-তমুক স্কুল এমপি ভুক্ত হয়েছে, এ নিয়ে হেড সারের সাথে কথা হয়। তার বন্ধুরা সবসময় তাকে ভুল তথ্য দিয়ে মজা করে এটা উনি মানতেই চান না।
তার একটা মেয়ে ছিলো, তাকে এক সম্ভ্রান্ত লোভি পরিবারে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেন। তারা বার বার যৌতুকের টাকা দাবি করাতে শেষমেশ গাজী স্যারের মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
মেয়ে মারা যাবার পর তিনি একদম একা হয়ে যান। লেখক বারবার খোঁজ নিতে থাকেন তার তার পরে বেরিয়ে আসে মূল ঘটনা!
তিনি সবার চেয়ে গরিব ছিলেন। উনার উপরিভাগ দেখে কখনই বুঝা যেত না উনি কষ্টে আছেন, সব সময় হাসিখুশি থাকেন, কাউকে কিছু বুঝতে দেন না।
লেখক তার খোঁজ নিতে গিয়ে এসব সামনে চলে আসে।
সবাই জানতো তিনি স্কুলের টিফিনের সময় বাসায় যেত খেতে, বাসায় খাবার খেয়ে আবার আসতো, কিন্তু লেখক খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন তিনি কখনোই টিফিনে বাসায় যেত না, রাস্তার একটা চায়ের দোকানে একটা রুটি একটা বিস্কুট এবং চা খেয়েই চলে আসতো, বাসায় ফেরার পথেও বিস্কুট রুটি খেয়ে চলে যেতেন।
সবার সামনে এসে অভিনয় করে দেখাতেন মনে হয় তিনি মাংসদিয়ে ভাত খেয়ে এসেছেন।
লেখক তার বাসায় কয়েকবার ঘুরতে যায় সেখানে তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন।
বোকা মাস্টার বিনা বেতনে চাকরি করে ইটের ভাটায় গিয়ে কাজ করে সংসার চালাত!
লেখক এসব দেখে খুব কষ্ট পান, তাকে সহযোগিতা করেন, এ নিয়ে স্কুলে কথা বলেন তারজন্য কিছু পরিমান বেতনভুক্ত করার জন্য কথা বলে।
হেডস্যার একমত থাকলেও বাকি কেউ একমত হন না।
এক সময় এই স্যারের হার্টঅ্যাটাক হয়ে হাসপাতাল যায়, ডাক্টার বলেছে হার্টে রিং লাগালে বাঁচানো যাবে না হলে আশা নেই। স্কুল থেকে সবাই আলোচনা করেন তার চিকিৎসা কারাবেন, লেখক প্রস্তাব তুলেন স্কুলে দুটো গাছ ছিলো এটা তার চিকিৎসার জন্য বিক্রি করে খরচ করবেন, কিন্তু সভাপতি এতে বাধা প্রদান করেন এতে কেউ কিছু বলে না।
অবশ্য গাজী স্যার স্কুলের অনুদান নিতে রাজি হন নাই, তিনি তার ভিটেমাটি বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে বলেন। দায়িত্ব দেন লেখকের কাছে। লেখক নিজের টাকায় চিকিৎসা করাতে চাইলেও অশিকার করেন। তিনি কারো কাছে সাহায্য কামনা করেন না।
একসময় উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতা নেওয়ার সব ব্যবস্থা করেন লেখক, তার পরপরেই খবর আসে তিনি মারা গেছেন।
পুরো উপন্যাসটি পড়ে কখনো হেসেছি কখনো নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসেছিলো।
সমাজে এরকম বহু আলোর ফেরিওয়ালা আছে আমাদের চারোপাশে, হয়তো তাদের আমরা মূল্যায়ন করছি না, বোকা মাস্টার নামেই ঠাট্টা বিদ্রুপ করেই চলছি।
সেলুট জানাই এসব আলোর ফেরিওয়ালাদের, তারা বেঁচে থাক যুগ যুগ ধরে।
সব বয়সি বই প্রেমিদের আহবান করছি বইটি পড়ার জন্য, আশা করি পড়ে অনেক উপকৃত হবেন।