বই রিভিউ ও ডাউনলোড

বিন্দু বৃত্তান্তে বই রিভিউ – রেশমী রফিক

বই:বিন্দু বৃত্তান্তে
লেখিকা:রেশমী রফিক
প্রকাশনা:অন্যধারা
প্রচ্ছদ:আরিফুল হাসান
দাম: ৬৪০ টাকা
সুইটহার্ট আমি চাই তুমি বিষ খেয়ে সুইসাইড করবে।পারবে?
আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে নানা রকম অপরাধ।সেই অপরাধ শুধু ঘরের বাইরেও সীমাবদ্ধ নেই বরং অক্টোপাসের মতো আমাদের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে।টিভি ছাড়লেই সেই অপরাধের খবর আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে।খবরে শোনা নিউজে যে আঙ্গিকে প্রবেশ করে ঠিক সেভাবেই আমরাও চিন্তা করি সাসপেক্টেড ব্যাক্তিই খুনী।কিন্তু আসলেই কি তাই?
যেই ব্যাক্তি খুন না করেও ক্রমাগত জেরার মুখে জেরবার,সবার সন্দেহের দৃষ্টি যাকে এঁফোর ওঁফোর করছে সে কি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে?
আর সাদা চোখে আমরা যা দেখি, তা কি আসল সত্য?নাকি সত্যের রূপভেদ আছে?
সারসংক্ষেপ:
রূপন্তি তূর্যকে নিয়ে পালাচ্ছে।বাঘ নাকি ক্ষুধার্ত হলেই নিজেই নিজের সন্তানকে খেয়ে ফেলে।সেই হিংস্র বাঘ থেকে সন্তানকে বাঁচানোর জন্য বাঘিনী মরিয়া হয়ে ওঠে তেমনি রূপন্তি তূর্যকে নিয়ে তুহিনের সাম্রাজ্য থেকে পালাচ্ছে।কিন্তু আসলেই কি সে পালাতে পারবে?
পুরো সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি করে দিয়েছে রূপন্তিকে তুহিন।আর পাঠিয়েছে মুক্তি পরোয়ানা।কিন্তু এর মধ্যেও কি কোনো কূট চাল আছে তুহিনের?
তুহিনের ডায়েরি পড়ে খুঁজে পেলো অন্য এক তুহিনকে রূপন্তি।ফিরতে চাইলো আপন সম্রাটের সম্রাজ্ঞী হয়ে।কিন্তু একি!লন্ডভন্ড প্রাসাদ,সারা ঘরময় প্রলয়ংকারী ঝড়ের তান্ডব?তুহিন কই?কি হয়েছে তুহিনের?
রূপন্তি কি পাবে তার স্বপ্নের রাজপুত্রের দেখা?
জনরা:
বেশ কিছু বছর আগে থ্রিলার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কিছু লাইন পড়েছিলাম,সেই লাইনগুলো পড়ে মনে হয়েছিল,

ii04i59q">

থ্রিলারকে চিহ্নিত ও সংজ্ঞায়িত করা যায় তাদের প্রকাশিত ভাব দিয়ে। তারা পাঠকের মধ্যে জাগিয়ে তোলে সাসপেন্স, উত্তেজনা, বিস্ময়, পূর্বাভাস এবং উৎকণ্ঠা।
থ্রিলারের কাহিনি ক্লাইম্যাক্সের দিকে যত এগোয়, পাঠকও উত্তেজনায় “চেয়ারের কিনারায়” এগিয়ে আসে। দর্শকের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লুকিয়ে রাখা থ্রিলারের বহুলব্যবহৃত উপাদান।সাহিত্যিক কৌশল, যেমন লাল হেরিং, কাহিনিমোচড়, এবং ক্লিফহ্যাঙ্গার ইত্যাদিও প্রচুর ব্যবহৃত হয়। থ্রিলার সাধারণত খলনায়ক-চালিত কাহিনি, যেখানে সে বিভিন্ন বাধা সৃষ্টি করে আর নায়ক সেসব পরাস্ত করে যায়।
বইটা থ্রিলার বা ক্রাইম ইনভেস্টগেশনের উপর নির্ভর করে যদি বলা হয় তাহলে তা থ্রিলার জনরার।আবার যদি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এর আঙ্গিকে বিবেচনা করি তাহলে মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস।আবার যদি সমকালীন সমাজের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে চিন্তা করি তাহলে একে সমকালীন উপন্যাস ও বলা যায়।
তবে পাঠক হিসেবে আমার কাছে সমকালীন মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস এই জনরায় ফেলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হচ্ছে কেননা থ্রিলারের ক্ষেত্রে বইয়ের মাঝের অংশের একটু পরেই আসল কালপ্রিট কে তা guess করতে কষ্ট হয় নি।
নামকরণ:পুরো ঘটনাটাই বৃত্তের মূল বিন্দু বা সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে।আর এই মূল বিন্দুকে কেন্দ্র করে পুরো ঘটনা ৩৬০ ডিগ্রি আবর্তিত হয়েছে।তাই নামকরণ যথার্থ।
প্রচ্ছদ: Royal Black এর এই বারের প্রচ্ছদ দেখে পাঠক হিসেবে আমি খুব আকর্ষণ বোধ করেছি।কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে সোনালি রংয়ে একজন নারী ও পুরুষের পরষ্পরের কাছে সমর্পণ এর চিত্র বইটির মূলভাবের সাথে দারুণভাবে মিলে গিয়েছে।
শুধু আমি নই আমার পরিবারের যেই এই বইটা হাতে দেখেছে সেই নজরকাড়া প্রচ্ছদের জন্য তারিফ করেছে।
পাঠপ্রতিক্রিয়া:
গল্পটার কথক ছিলো রূপন্তি,যে গল্পের শুরু থেকে তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজের thought process অনুযায়ী গল্পটা বলেছে।সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে চরমতম বেয়াদব, rude তুহিনের উপর এত এত রাগ হয়েছে।মনে হয়েছে রূপন্তির জায়গায় আমি থাকলে তুহিনের ভর্তা করে ফেলতাম।কিন্তু প্রেক্ষাপট পালটে যেতেই, তুহিনের আকষ্মিক প্রস্থানের পর রূপন্তির ডায়েরি পড়ার মধ্যে দিয়ে পাঠককে তুহিনের প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছে।ঘটনার অগ্রগতিতে ভিলেন থেকে নায়করূপে আবির্ভূত হয়েছে।
বেশ কিছুদিন আগে Dan brown এর লেখা Angels and demons পড়ার পর মনে হয়েছিলো,সব মানুষের মধ্যেই Angel আর Demon দুটি সত্তা থাকে।আমাদের উপর নির্ভর করে আমরা কোন সত্তাকে প্রাধান্য দেই।
লেখিকা খুব চমৎকারভাবে তুহিনকে ভিলেনরূপে আবির্ভূত করলেও ধীরে ধীরে তার চারপাশে আলোজ্বল করেছে।আলোয় আলোকিত তুহিনকে সবার সামনে এনেছেন।
মানসিক বিকারগ্রস্ততা আর লোভ মানুষকে কতোটা নিচে ঠেলে ফেলে দিতে পারে তাই যেন ফুটে উঠেছে শেষ অংশে।
বইয়ের সবচেয়ে দারুণ লেগেছে তূর্যর সাথে তুহিনের সম্প র্কের transformation।
বইটির মধ্যে লেখিকা বেশ কিছু মেসেজ দিয়েছেন যা আমাকে চিন্তা করতে, একটু থমকে যেতে বাধ্য করেছে।সেই মেসেজগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলঃ
১/Introvert স্বভাবের মানুষের বাহ্যিকরূপ দেখে বিচার না করে তার মধ্যে চলমান দ্বিধা দ্বন্ড নিয়ে, তার ভেতরের মানুষকে চিন্তে চেষ্টা করা উচিৎ।
২/পরিবার মানুষের সবচেয়ে ভরসাস্থল। আর যে কোনো কারণেই সেই ভরসাস্থল কেড়ে নেয়া উচিৎ নয়।মানুষ নিজের ভরসাস্থল হারিয়ে ফেললেই ভুল পদক্ষেপ নেয়।
৩/পরিবারে নতুন সদেস্যরূপে বউ এলে আমরা class difference বা অন্য যে কোনো ধরনের মানদন্ডে বিবেচনা করে তাকে কটূ কথা না বলি বা কটূ আচরণ না করি।একটি গাছকে তার মূল থেকে উপড়ে এনে নতুন পরিবেশে পুনরায় লাগালে তার ঐ পরিবেশে অভিযোজিত হতে ও বেশ খানিকটা সময় লাগে।সেখানে নতুন বউ একজন মানুষ যার শিকড় ছেড়ে সে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে যে প্রয়োজনীয় সময় লাগে সে সময়টুকু দেয়া উচিৎ।
৪/খোলাচোখে কারো বাহ্যিক আচরণ দেখে তাকে বিচার করা
ঠিক নয়।একটা বইয়ের কাভার নয় বইয়ের ভেতরের তথ্য উপাত্ত দিয়ে বইকে judge করা উচিৎ নয়।তেমনি মানুষের বাহ্যিক ব্যবহার দিয়ে বিবেচনা করা ঠিক নয়।
৫/অপরাধীকে বিভিন্ন কারণ চিন্তা করে মানবিকতা দেখিয়ে মাফ করা ঠিক নয়।কারণ আঘাত প্রাপ্ত সাপ আর ও বেশি ভয়ংকর।আহত বাঘ ঘাতকরূপে মানুষখেকো বাঘে পরিণত হয়।তাই তার নিধন বা শাস্তিই প্রকৃত ঔষধ।
৬/মাতৃরূপের যে দুই বিপরীতমুখী চিত্র এঁকেছেন লেখক তা দারুণ লেগেছে।পড়তে পড়তে এক সময় হিন্দু পুরাণের মা কালী যে সমস্ত জগৎের জন্য অসুরের বধ করেছে,স্বামীর বুকে পা দিয়েছে সেই সর্বসংহার কথা মাথায় এসেছে তেমনি গ্রীক মিথোলজির ক্রেনসের কথাও মাথায় এসেছে যে নিজের স্বার্থে নিজের সন্তান ভক্ষণ করতে দ্বিধা করে না।
সমালোচনাঃ
কাহিনীর ঘটনা প্রবাহে একজন পাঠক হিসেবে ডুবে গেলেও থ্রিলারপ্রেমী হিসেবে বইয়ের মধ্যভাগ শেষ হবার পরেই মনে হয়েছে দূর্বল হয়ে গেছে।ক্লাইম্যাক্সটা নিজের হাইটে উঠার আগেই মধ্য রাস্তায় বিদ্ধস্ত হয়েছে।কিন্তু সমকালীন উপন্যাস হিসেবে যদি মনোযোগ এক মুহুর্তের জন্য অন্য কোথাও সরাতে পারে নি।
স্বার্থপরতার যে চিত্র লেখক অঙ্কন করেছেন সেই চিত্র প্রথমবার পড়ার সময় একটু থমকে গিয়েছি।চিন্তা করেছি একি সম্ভব?আবার খবরের কাগজ এ চোখ গেলেই মনে হয়েছে সম্ভব তা এ জীবনেই।
বইয়ের ঘটনাপ্রবাহের জন্য বেশ বড় হয়েছে বইটা কিন্তু বেশ কিছু অধ্যায়ের শেষে ফাঁকা জায়গা থাকার জন্য আর ও বেশি বৃহৎ হয়েছে বইয়ের আকার, যার ফলে মূল্য বেশ বেড়ে গেছে।
উপসংহার:
লোভে পাপ,পাপে মৃত্যু।আর এই লোভের বিনাশ কতটুকু হতে পারে তারই স্বার্থক রূপায়ন বিন্দু বৃত্তান্তে।বইটির সমালোচনা সম্পর্কে বলতে চাই,কারো অনুভূতি, মনের ক্যানভাসে ফুটে ওঠা চরিত্রগুলোর রূপায়ন একজন লেখকের জন্য যতোটা কঠিন, একজন পাঠকের সেই বইটা পড়ে সমালোচনা করা ততটাই সহজ।তবে লেখকের সেই পবিত্র মনোভূমির স্থান সবকিছুর উপরে,সব সমালোচনার উর্দ্ধে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button