বই রিভিউ ও ডাউনলোড

যোগাযোগ রবীন্দ্রনাথ বই রিভিউ

‘চোখের বালি’র পরেই ‘যোগাযোগ ‘ রবীন্দ্রনাথের অন্যতম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। পুরো উপন্যাস টা জুড়েই যেনো উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র কুমুর নিজের সাথে সংসারের অসামঞ্জস্যতার লড়াই ফুঁটে উঠেছে। মনস্তাত্ত্বিক এই উপন্যাসটি নিজের মনের সব অনুভূতি গুলোর মধ্যেও কেমন একটা ঝড় তুলে।
উপন্যাসের গল্পটি কুমিদিনীর, যে নিজের ভাই বিপ্রদাসের আদর্শে মানুষ। তৎকালীন সমাজে বড়ো হয়েও যে নিজের স্বান্তন্ত্র্যকে চিনতে পেরেছিলো।ভাই বিপ্রদাসের সাথে নির্মল ভালবাসার , ভাইয়ের আদর্শে স্বতন্ত্রতা নিয়ে বড় হয়ে ওঠে কুমু।

দৈবের প্রতি অগাধ বিশ্বাস নিয়ে পারিবারিক শত্রুতার ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও মধুসূদনকে বিয়ে করে কুমুদিনী, ভাইয়ের অনিচ্ছায় ই। কিন্তু যে ভালবাসার নৈবেদ্য সাজিয়ে নিয়ে সে এসেছিল, বুঝতে পারে তার অযোগ্য পাত্র মধুসূদন। ভালবাসা না পাওয়ার চেয়েও ভাল না বাসতে পারার দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে সে পুরোটা উপন্যাস জুড়ে।

চাটুজ্যে এবং ঘোষালে দ্বন্দ সমাস।
এককালে ঘোষাল পরিবার এবং চাটুজ্যে পরিবার ছিল একই গ্রামে।প্রতিমা নিয়ে দ্বন্দের জের ধরে ঘোষাল পরিবার হল গ্রাম ছাড়া।কিন্তু এই দ্বন্দের কথা আবহমান কাল ধরে দুইপক্ষের কাছেই স্মরণীয় অতীত।
উপন্যাসের কাহিনী গড়িয়েছে অবিনাশ ঘোষাল,বর্তমান ঘোষাল বংশের রক্ষকের বাবা মধুসূদন ঘোষাল এবং চাটুজ্যে পরিবারের শেষ কন্যা কুমুদিনী কে নিয়ে।
এক সময়ে অতীতের মন্দা কাটিয়ে বিত্তশালী হয়ে মধুসূদনের শখ জাগে তাদের পুরোনো দিনের শত্রু চাটুজ্যে বংশের কন্যাকে বিয়ে করে তাদের পুরোনো দ্বন্দের ম্রিয়মাণ ঘাঁ কে নতুনকে জাগিয়ে তোলার।অতীতের প্রতিদ্বন্দ্বী বিত্তশালী পাত্রের কাছে আদরের ছোট বোনকে বিয়ে দিতে সংকোচ ছিল কুমুদিনীর বড় ভাই বিপ্রদাসের।কিন্তু কুমুদিনীর সম্মতি এবং আর্থিক দূর্দশার কথা চিন্তা করে বিয়ে হয় তাদের।
বিয়ের পর কুমুদিনী লক্ষ করে মধুসূদন আর ও দুইজনই বিপরীত ধাঁচের মানুষ।যেমন তেল পানির সাথে কখনও মিশতে চায় না তেমনি কুমুদিনী আর মধুসূদনের অবস্থা ও হয়েছিল। একই সাথে কুমুদিনীর দেবর নবীন আর তার স্ত্রী মোতির মার সাথে কুমুদিনীর সম্পর্কের সূক্ষ পরিবর্তন ও মূল গল্পের পাশাপাশি চলতে থাকে।
কিন্তু সবকিছুর মাঝে থেকেও অন্যধাতুতে গড়া কুমুদিনী কি শেষ পর্যন্ত সকল অপমান নির্যাতন সহ্য করে স্বামীর ঘর করতে পেরেছিল?নাকি একসময়ে সেও মুক্তির পথ খুঁজতে উদ্যত হয়েছিলো?
#পাঠ_প্রতিক্রিয়াঃ
বরাবরের মতোই কবিগুরুর উপন্যাস যেনো মনকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে কিছুক্ষন। গল্পের কুমুর প্রতি পাঠকের যে ভালোবাসা জন্মাবে তার পুরোটাই যেনো বিপ্রদাস চরিত্রের জন্যই সম্ভব হয়েছে। এই চরিত্রটি নিঃসন্দেহে উপন্যাসের সবচেয়ে ব্যক্তিত্বপূর্ন চরিত্র। তবে গল্পের শুরুতে অসহায় কুমুকে যে পরম মমতায় কাছে টেনে নিয়েছিল মোতির মা, যতই কুমু নিজের সম্মানের জন্য লড়াই শুরু করে কেমন যেন চিড় ধরে যায় মোতির মার আর তার সম্পর্কে, এই বিষয়টা আমাকে মানসিক পীড়া দিয়েছে যেনো কবিগুরুর ভাষায়,
“মেয়ের সম্মান ময়েদের কাছেই সবচেয়ে কম।তারা জানেও না যে, এইজন্যে মেয়েদের ভাগ্যে ঘরে ঘরে অপমানিত হওয়া এত সহজ। তারাআপনার আলো আপনি নিবিয়ে বসে আছে।”
পুরোটা উপন্যাস জুড়ে যে পরিমাণ মানসিক দ্বন্দ্ব ছিল, আর অসাধারণ অনেকগুলো লাইন মনে গেথে আছে, “কিন্তু আরম্ভের পূর্বে ও আরম্ভ আছে, সন্ধ্যের দীপ জ্বালানোর পূর্বে সলতে পাকানো।”
আর সবশেষে বলতে গেলে কোথায় যেনো বইটাতে একটা ছোটগল্পের অদৃশ্য সুর লাগানো, শেষ হয়েও হইলো না শেষের মতো। নিঃসন্দেহে মোহাবিষ্ট করার মতো একটা পাঠ্য উপন্যাস ‘যোগাযোগ ‘।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button