Currently set to Index
Currently set to Follow
বই রিভিউ ও ডাউনলোড

প্রিয় চন্দ্রিমা রিভিউ – শারমিন আঞ্জুম

বইঃপ্রিয় চন্দ্রিমা
লেখিকাঃশারমিন আঞ্জুম
প্রকাশনাঃবই বাজার
প্রচ্ছদঃনির্ঝর নৈঃশব্দ
প্রকাশঃবইমেলা২০২১
মূল্যঃ৫০০টাকা
ভালোবাসা!সে কি?
নিজের রঙ না হারিয়ে অন্যের রঙে রঙিন হবার নাম ভালোবাসা।
ভেতরের রোদ্দুরটাকে না লুকিয়ে অন্যের ছায়ায় শান্তির নীড় খোঁজা ভালবাসা।
ঝোঁকের বশে ধরে ফেলা হাতটাকে নিজের করে ভেবে নেয়াই ভালোবাসা
আসলে এ বড্ড গোলমেলে, বেখাপ্পা বোকামি, এর নামই তো ভালোবাসা
লাভক্ষতির হিসেব না জানা অদ্ভুতরকম এক মূর্খতাই ভালোবাসা।
প্রিয় চন্দ্রিমা একুশ বছরের এক স্বপ্নবাজ,ফূর্তিবাজ তরুণীর ডায়রিতে লেখা এক মিষ্টি গল্প যা বহুদিন ডায়রির পাতায় ছিল।পরিণত বয়সের বিভিন্ন লেখালেখির মাঝে লেখিকা সেই সরলতাপূর্ণ মিষ্টি প্রেমের গল্পটাকে মননশীলতা,তীক্ষ্ণ জীবনবোধ, মার্জিত রুচিশীলতা দিয়ে আরও পরিণত করেছেন।
গল্পের ধরনঃআমেরিকার রোমান্স লেখকদের মতে,একটি রোমান্স উপন্যাসের কেন্দ্রীয় প্লট অবশ্যই দুজনের প্রেম ও প্রণয় সম্পর্ককে ঘিরে গড়ে উঠতে হবে।উপন্যাসের সংঘাত বা কনফ্লিক্ট ও সংকট বা ক্লাইম্যাক্স এই প্রেম সম্পর্ক গড়ে উঠার মূল থিমের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকবে।রোমান্সধর্মী উপন্যাস হতে পারে সমকালীন বা টাইম ট্রাভেলিং সম্পর্কিত।প্রিয় চন্দ্রিমা বইয়ের মূল চরিত্র অর্ক আর চন্দ্রিমা,পাশের বাড়ির ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়ের মিষ্টি প্রেমের কাহিনী।এই দুই চরিত্রের প্রণয়,ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আর সম্পর্কের টানাপোড়েন চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে।তাই বলা যায় প্রিয় চন্দ্রিমা বইটি রোমান্টিক সমকালীন উপন্যাস,যাতে চমৎকার এক প্রেমকাহিনীর সাথে সাথে লেখিকা সমকালীন প্রেক্ষাপট ও খুব সুচতুর ভাবে একেঁছেন।
গল্পের প্লটঃগল্পের প্লট একদম সাধারণ,আমাদের জীবনেরই এক অংশ যেন।প্রতিবেশী সদ্য কৈশোর পেড়োনো একটি মেয়ের সাথে অষ্টাদশী যুবকের প্রথম অনুরাগ পর্ব হলেও জীবনের

নানা সংঘাত আর ঝড় পেরিয়ে তা শ্বাশত প্রেমে রূপ নেয় যখন মেয়েটি ডাক্তারি পড়তে থাকে তখন।মিহির ছদ্ম নামে অর্কের সমর্পণ যেন কৈশরের প্রেমটাকে আরো বলীয়ান করে দেয়।গল্পের প্লট যেন লেখিকা চরিত্রের চিত্রণে ব্যবহৃত চার লাইনের প্লটেই বুঝিয়ে দিয়েছেন,

“তুমিহীনা আমি যেন প্রাণহীন এক মাটির প্রতিমা,
তোমাতেই পরিচয় আমার আমাতেই শক্তি তোমার
অর্ক তুমি আমার আমি তোমারই,প্রিয় চন্দ্রিমা;
ঝড় যদি আসে খুঁটি হয়ে যাব,শত আঘাতে আমি ঢাল হয়ে রব
ভাঙতে দেব না কভু তোমার এ গড়িমা;
অর্ক তুমি আমার আমি তোমারই প্রিয় চন্দ্রিমা।”
চরিত্র মঞ্চায়নঃ গল্পের প্রতিটি চরিত্র যেন চন্দ্রিমা আর অর্কের সম্পর্কের ক্রিয়া বিক্রিয়ার সাথে সমানতালে আপন চরিত্রে তাল মিলিয়ে চলছে।গল্পের চরিত্রগুলা যেন আমাদেরই প্রতিরূপ।তাই তো নিগার, নিলুফার,অবন্তী, সজল প্রতিটা চরিত্র যেন আমাদের চোখের সামনে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে।নিজেদের মেলে ধরছে নিজ ভূমিকায়।তবে আমার প্রিয় চরিত্র হলো চন্দ্রিমা,তবে চন্দ্রিমা আমার প্রিয় হলেও অর্কের চরিত্রের কিছু ব্যাপার দারুণ লেগেছে চেষ্টা করব তাও উল্লেখ করতে।
চন্দ্রিমাকে ভালো লাগার কারণঃ
আমরা আবেগের বশে বা ক্ষণিকের ঝোঁকে প্রিয় মানুষের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে ফেলি কিন্তু যখন হুশ ফিরে আসে তখন আরও বেশি জড়িয়ে যাই সেই সম্পর্কের বাঁধনে।কিন্তু সেই সম্পর্কটার জন্য আদৌ কি আমরা প্রস্তুত তা ভাবি না।আর একবার যদি আবেগের স্রোতে ভাসতে শুরু করি নিজেরাও জানি না কোথায় হারিয়ে যেতে থাকি।কিন্তু আবেগের বশে অর্কের হঠকারী আচরণে নিজেকে ভেসে যেতে দেয়নি।শক্ত করে রুদ্ধ করেছে আবেগের স্রোতকে,আগল দিয়েছে মনের সেই কুঠুরিতে যা খুব কম মানুষই করতে পারে।
নিজেকে যোগ্য করতে করতে আমাদের মধ্যে এক ধরনের অহমিকা চলে আসে, আর সেই অহমিকা বা অহংকারের জন্য আমাদের ভেতরে থাকা মানবিক চেতনাগুলো কখন লুপ্ত হয় তা নিজেই জানি না।কিন্তু খুব কম মানুষই নিজের শ্রেষ্ঠত্বের বাইরে অন্যের ক্ষতগুলোকে দেখতে পায় আর তাতে ভালবাসার প্রলেপ দিতে পারে।
কারো অতীত থাকা মানেই সে পঁচে গেছে তা নয়।রবীন্দ্রনাথের একটা লেখায় পড়েছিলাম,ক্ষমাই যদি করতে না পারো তবে ভালোবাসো কেন?চন্দ্রিমা যেভাবে অর্কের অতীতকে পেছনে ফেলে সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ সাজাতে চেয়েছে তা খুব কম এ সমাজে দেখা যায়।
অন্যায়ের সাথে আপোষহীনতা তা যেন চন্দ্রিমার চরিত্রের উজ্জ্বল এক তারা।জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের সাথে নানারকম নির্যাতনের খবর শোনা যায়,কেউ হয়তো শ্লীলতাহানি হচ্ছে কেউ বা নিঃশব্দে নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছে।কিন্তু খুব কম মেয়েই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।
সৎ মায়ের অত্যাচারে বিষ খাওয়া এক পেশেণ্টের কেস ফাইল স্টাডি করতে করতে নিজের চিন্তা ভাবনা আর অনাগত ভবিষ্যৎে নিজের কর্মের প্রতি সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি।উদার মনোভাবের সাথে দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি খুব দেখা যায়।
অর্ক আর চন্দ্রিমার কথোপকথনঃ
‘থাক অর্ক, আমার এখানের ডিগ্রীই ভালো।তোমার লাল ব্রিটিশ পাসপোর্ট যেভাবে পেয়েছো,সেটা আমার নিজের প্রয়োজনে কখনো ব্যবহার করব না।এই বিষয়ে নিশ্চিত থেকো।’
এই লাইনটা পড়ার পর প্রথমেই মাথায় আসবে যে এই কথাগুলো বলছে সে একজন প্রচন্ড আত্বসম্মানী মানুষ।যার কাছে জীবনের সুখ, প্রাচুর্য,আর প্রাপ্তির চেয়ে আত্বসম্মান বেশি প্রিয়।৬ ক্যারেটের হীরে নয় নিজের যোগ্যতাই তার ভূষণ।
প্রিয় মানুষের আনন্দের মাঝে আনন্দ খুব কম মানুষ খুঁজে নিতে পারে।সিদ্ধান্ত নেবার পর সবাই সে সিদ্ধান্ত বয়ে নেবার ভার নিতে পারে না।মানুষ ভুলে যায়,”ভালবাসা যেখানে গভীর নত হওয়া সেখানে গৌরবের”।রবীঠাকুর যেন অর্ক আর চন্দ্রিমার জন্যই লেখেছে, দু জন দুজনার ভালবাসায় নত হয়েছে।
এবার আসি অর্কের চরিত্রের উল্লেখযোগ্য দিকঃ
পরিচিত কোনো মেয়ের সাথে অন্যায় হলে আমরা চুপ থাকি,তাকেও চুপ থাকতে বলি সমাজের তথাকথিত বদনামির ভয়ে।কিন্তু সেই বিপদের মুহূর্তে খুব কম মানুষ শক্ত হাতে হাত ধরতে পারে।অন্যায়কারীকে যোগ্য স্বাক্ষীর ব্যবস্থা করতে পারে।অর্কের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চন্দ্রিমাকে দেয়া সাহস, শক্তি আমার জন্য এক দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল।নিজের উচ্চাভিলাষ বা স্বপ্নের পেছনে ছুটা অন্যায় নয়।কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের পাথেয়টা ভুল না হয়ে যায়।কিন্তু অনেকেই ভুল করলেও সেই ভুলটাকে স্বীকার করার সৎ সাহস খুব কম থাকে।বিদেশে গ্রীণ কার্ডের জন্য বিয়ে অনেকেই করে,আবার দেশে ফিরে বিয়ের বাজারে মোস্ট এলিজ্যাবল ব্যাচেলার এর তকমা লাগিয়ে কুমারী বউ খুঁজে বেরায়।কিন্তু নিজের সত্যি অকপটে বলার সাহস কয় জনের থাকে?অনেকদিন আগে কিছু লাইন পড়েছিলাম,বিয়ে করলে মানুষকে মেনে নিতে হয়, তখন আর গড়ে নেবার ফাঁক থাকে না।আমার প্রিয় মানুষটা যেন সংসারে মানিয়ে নিতে গিয়ে হারিয়ে না যায়, তার ইচ্ছা,স্বপ্নগুলি যেন সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট না হয় এই বিবেক, এই সংবেদনশীল মনোভাব কয় জনের থাকে!
সাবলীলতাঃগল্পের সাবলীলতা নিয়ে।লেখিকা শারমিন আঞ্জুমের লেখনীর নিজস্ব একটা স্টাইল আছে।আর এই স্টাইলের মধ্যে একটি হলো গল্পের সাবলীলতা আর একটা ছোট্ট মেসেজ যা লেখিকার অন্য সব গল্পের মতো প্রিয় চন্দ্রিমাতে প্রতীয়মান হয়েছে।
পাঠপ্রতিক্রিয়াঃগল্পটা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে লেখিকা খুব সূক্ষ্মভাবে প্রেমকাহিনীর পাশাপাশি আমাদের জীবনবোধ নিয়েও শিক্ষা দিয়েছেন।প্রিয় চন্দ্রিমা যেন এক ফেইরি টেইল।ফেইরি টেইলে যেমন রাজকন্যা, রাজপুত্র থাকে তেমনি থাকে খলনায়িকারূপি ডাইনি।সবসময় যে ডাইনিকে ব্যাক্তিরূপে আগমন করতে হবে তা নয় আমাদের নেয়া হঠকারী সিদ্ধান্তই আমাদের জীবনের ভিলেনরূপে দাঁড়ায়।গল্পটা যারা পড়েছেন তারা অনেকেই বলবে ডেইজি জাফর গল্পের মেইন ভিলেন।কিন্তু আমার কাছে ডেইজিকে main protagonist লেগেছে।ডেইজির চরিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ যেন অর্ক আর চন্দ্রিমার চরিত্রকে বিকাশ হতে সহায়তা করেছে।
পর্যালোচনাঃগল্পের প্লট নিঃসন্দেহে চমৎকার।প্রিয় চন্দ্রিমা একটি মিষ্টি প্রেমের গল্পটাকে যদি খুঁটিয়ে লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায়,খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জিনিস লিখেছেন।চমৎকার রূপ ল্যাবণ্যে ভরা ডেইজি জাফরের বিলাসবহুল জীবনের মধ্যে যে এক নিঃসঙ্গতাও থাকে তা যেমন দেখিয়েছেন তেমনি কাস্টিং কাউচের মতো স্পর্শকাতর ব্যাপার ও ছদ্মাবরণে লিখেছেন।রোমান্টিক মুহূর্তগুলিতে অনেকেই অশ্লীল দৃশ্যের অবতাড়না করেন।vulgar আর sensual এই দুইয়ের মধ্যে খুব thin line থাকে।বাসর রাতের দৃশ্যে যা খুব দারুণভাবে লেখিকা সেই thin line maintain করেছেন।
প্রচ্ছদঃগল্পের প্রচ্ছদে দাঁড়ানো মেয়েটি যেন চন্দ্রিমার প্রতিচ্ছবি।
প্রকাশনীঃ বইবাজার প্রকাশনী গল্পটিকে বইয়ে রূপ দিতে যথেষ্ট যত্নবান ছিল।বইয়ের বাইন্ডিং,নতুন অনুচ্ছেদে যাবার সময় অহেতুক গ্যাপ না দেয়া,প্রুফ রিডিং এবং সামগ্রিক সম্পাদনায় দারুণ কাজ করেছে।তবে কিছু ছোট ছোট বানান ভুলের জন্য বইটা পড়তে বিরক্ত লেগেছে যা অনেকটা চাঁদে কলংকের সমতুল্য।তাই প্রকাশনীকে প্রুফ রিডিং এ আরেকটু মনোযোগী হবার পরামর্শ দিব।
উপসংহারঃ গল্পটা পড়ার পর সমালোচনার মতো কিছু চোখে পড়ে নি।হয়তো অনেকেই বলবে এই মিষ্টি গল্পের মধ্যে লেখিকার প্রকৃত লেখিকা সত্তা বের হয়ে আসে নি বা প্লটটা খুব হালকা হয়ে গেছে।কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার পড়ার পর লেখিকা খুব সূক্ষ্ম মেসেজ দিয়েছে চন্দ্রিমা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে আজকের কিশোরী মেয়েদের,
“Life is not about finding yourself,life is about creating yourself”.Twinkle khannaর লিখা এই লাইনটাই যেন চরিত্রের কর্মের মধ্যে দিয়ে লেখক তুলে ধরেছেন।
দাম্পত্য এমন এক আর্ট যা প্রতিনিয়ত চর্চা করতে হয়।আর সেই দাম্পত্যের সাথে যদি শ্রদ্ধার মিশেল ঘটে তবে তা আরও উপভোগ্য হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button