পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র pdf – Purnendu Patri kobita pdf download
All of Purnendu Patri kobita Complete pdf – পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতা সমগ্র pdf download links-
কালোপনিক ভূত পূর্ণেন্দু পত্রী বই রিভিউ-
মাসখানেক ধরে টেলিফোন ডেড। টেলিফোন করতে গিয়েছিলুম কাছাকাছি এক বন্ধুর বাড়িতে। আজ বিকেলেই যেতে হবে সিউড়ী। পরের ছবির লোকেশন দেখতে। সিউড়ীতে দিন কয়েক কাটিয়ে ম্যাসাঞ্জোর। ম্যাসাঞ্জোরে হল্ট করে দুম্কা অঞ্চলটা দেখে নেওয়া।
যাবার আগে ছবির প্রোডাকশন ম্যানেজারকে জরুরী কতকগুলো নির্দেশ দেওয়ার ছিল। টেলিফোন সেরে বাড়ি ফিরতেই দুই মেয়ে হৈ হৈ করে জানাল—
—বাপি টেলিফোন ঠিক হয়ে গেছে।
-সে কি রে? কখন?
–এ্যাই তো, তুমি বেরিয়ে গেলে, অমনি বেজে উঠল ঝন্ ঝন্ করে।
—কে ফোন করেছিল?
–এ্যাই দিদিসোনা, তুই তো ধরেছিলি, বল না!
—তুমি কালোপনিক নামে কাউকে চেনো?
—কালোপনিক? সে আবার কে? কি বলল তোকে?
—আমি জিজ্ঞেস করলুম, আপনার নাম কি? বললে বলবেন কালোপনিক।
-তারপর?
—তারপর তুমি কখন ফিরে আসবে জানতে চাইলো। আমি বললুম, আধ ঘণ্টা পরে।
-তারপর?
-বললে, ঠিক আছে, আমি যোগাযোগ করে নেবো। কিন্তু লোকটা যেন কী রকম।
-কী রকম মানে?
-উচ্চারণ-টুচ্চারণ কেমন যেন অদ্ভুত। অর্ধেক কথা বুঝতে পারা যায় না। খিনখিনে গলা। যেন বুড়ো মানুষ। আর খুব ভয় করছিল।
—টেলিফোনে কথা বলছিস, তাতে আবার ভয় কিসের?
-বললে তুমি বিশ্বাস করবে না…
—ব্যাপার কি বলবি তো।
—লোকটার সঙ্গে কথা বলতে বলতে টেলিফোনটা এমন ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল, আমি আর ধরে থাকতে পারছিলুম না। টেলিফোনটা যেন ডিপ ফ্রিজে রাখা ছিল, এমন ঠাণ্ডা।
–রাত জেগে পরীক্ষার পড়া পড়ছিস তো। তোর এখন মাথার ঠিক নেই। যাক্গে, ফোনটা এসে বাঁচিয়েছে। টালীগঞ্জে একটা আর্জেণ্ট ফোনের দরকার ছিল।
জামাটা খুলেই বসে গেলুম টেলিফোনের সামনে। আর হাত ছোঁয়ানো মাত্রই বুঝে গেলুম, সেটা ডেড। বড় মেয়ে অপুকে ডাকলুম চেঁচিয়ে।
–কি রে? তুই যে বললি, টেলিফোন ঠিক হয়ে গেছে, আমার সঙ্গে ঠাট্টা করলি বুঝি?
— সে কি? ঠাট্টা করবো কেন? টেলিফোন বাজল। প্রায় দুমিনিট কথা বললাম, সবাই তো শুনেছে। মাকে জিজ্ঞেস করো না।
ছেলে, মেয়ে, তাদের মা, সকলেই সায় দিল অপুর কথায়। মেজাজটা বিগড়ে গেল। টালীগঞ্জের সঙ্গে যাবার আগে কতকগুলো কথা বলে দিতে পারলে, সুবিধে হতো কাজের। রাগে টেলিফোনটাকে আছড়ে ভাঙতে ইচ্ছে করছিল তখন।
গাড়ি আসবে তিনটেয়। তার আগে তৈরী হয়ে নিতে হবে। জিনিসপত্র গোছানো হয়নি কিছু। লম্বা জার্নি। একটু খেয়ে নিয়ে সামান্য বিশ্রাম করে নেওয়া ভাল। উমাও তাই বললে।
—আগে স্নান করে খেয়ে নাও। রান্না রেডি। গোছ-গাছ আমরা করে দেবো।
স্নানের আগে দাড়ি কামাচ্ছি। রূপু দৌড়ে এসে ধাক্কা মারল দরজায়।
—বাপি, বাপি-ই…
—কিরে?
– টেলিফোন! আবার টেলিফোন বাজছে। সাবান মাখা মুখেই দৌড়ে এসে টেলিফোন ধরলাম।
-হ্যালো!
-আমি কালো স্যার!
-কে কালো? আমি আপনাকে চিনি?
-এজ্ঞে হ্যাঁ স্যার, একবার দেখা করেছিলুম ৬/৭ বছর আগে। তখন আপনি বেলগেছের মোল্লিকদের বাড়িতে ইস্তিরপত্তো-র ছুটিং করতেছিলেন। সি কথা আপনার এ্যাখন আর মনে নাই। তবে আপুনি কথা দেছিলেন…
—কি কথা?
—স্যার, কথা দেছিলেন একটা পার্ট দিব্যান পরের ছবিতে।
অপু ঠিকই বলেছিল। ক্রমশ হিম হয়ে আসছে রিসিভারটা। আর ওপারে `যার গলা, কথা বলছে যেন জলের ভিতর থেকে। অথবা লম্বা কোনো চোঙায় মুখ রেখে। ফাঁপা, খনখনে, গা-ছমছম ভুতুড়ে কণ্ঠস্বর। আমার অস্বস্তি করছিল।
—দেখুন, আপনার সব কথা আমি বুঝতে পারছি না। হয়তো টেলিফোনের লাইনটাই খারাপ। আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি। পরে ফোন করবেন।
—ব্যস্ত মানে ছুটিং করতে যাচ্ছেন নাকি স্যার?
—না, ছুটিং নয়, লোকেসান হাণ্টিং-এ।
–কুনদিকে যাচ্ছেন স্যার, জানতে পারি কি?
—সিউড়ী থেকে দুম্কার দিকে।
—আচ্ছা স্যার, তাই হবে। অধমের নামটা একটু মনে রাখবেন স্যার।
– কি নাম?
-কালোপনিক।
-বাঙালী?
-হ্যাঁ স্যার। চোদ্দপুরুষ ধরে। আদি বাড়ি নাকতলায়।
—বাঙালীর এরকম নাম শুনিনি তো। পনিক না বনিক?
—স্যার! আমার আসল নামটা ছেল গিয়ে কালোরাম পরামাণিক। ভূতের মুখে রাম নাম বলা তো বারণ। তাই হয়ে গেছি…
আমার হাত থেকে আছড়ে পড়ে গেল রিসিভার। রিসিভার ভাঙার শব্দে ছুটে এল সবাই। ভাঙা রিসিভারের ভিতর থেকে তখনো খিনখিনে চিনচিনে গলার স্বরটা শোনা যাচ্ছে…
-স্যাআর স্যাআর, স্যাআর…
-একি, তুমি এত ঘামছো কেন? কি হয়েছে? স্ত্রীর চোখে মুখে উদ্বেগ।
—কিছু নয়, গরমে। স্নান করলে ঠিক হয়ে যাবে। বাথরুমে ঢুকেই হুড়মুড় করে মাথার ব্রহ্মতালুতে চাপড়ে চাপড়ে মগ পাঁচেক জল। তারপর আধ-কামানো দাড়ি কাটা।
আবৃত্তির কবিতা সমগ্র pdf
সিউড়ীতে এসে গেছি সেদিন রাত্রেই। সকাল থেকে লোকেশন দেখার পালা। আমার সঙ্গে আছে ক্যামেরাম্যান শক্তি, আর অ্যাসিসট্যান্ট প্রোডাকশন ম্যানেজার বিশু। দিনের বেলায় যা-দেখার দেখে নিয়ে লাঞ্চ। লাঞ্চের পর একটু জিরিয়ে নিতে-না-নিতেই আমাদের অ্যামবাসাডর ছুটে চলল পশ্চিমমুখে। এখন আমরা চলেছি রেল লাইনের খোঁজে। রেল লাইনের এমন একটা জায়গা আমাদের দরকার, যেখানে অল্প দূরে থাকবে লেভেল ক্রসিং। গল্পের নায়িকা সেইখানে কাটা পড়বে ট্রেনে। যে-তিনটি ওয়াগন-ব্রেকার গল্পের নায়ক, তারা অনেক দূর থেকে ছুটে আসবে ঐখানে। নাটকীয় নানা রকম ঘটনা ঘটবে বলেই, জায়গা বাছাটা বেশ কঠিন। আবার সেটা হতে হবে শহর থেকে দূরে। নইলে দর্শকের ভীড়ে শুটিং ভণ্ডুল হওয়ার সম্ভাবনা ষোল আনা। একটা লেভেল ক্রসিং-এর সামনে গাড়ি থামিয়ে আমরা হাঁটছি।
হাঁটতে হাঁটতে কখন একা হয়ে গেছি। রেল লাইনের ধারে একটা অদ্ভুত জঙ্গল দেখে মনটা তখন নেচে উঠেছে আমার। ছবির জন্যে ঠিক এই রকমই একটা জঙ্গলের প্রয়োজন ছিল, রেল লাইনের ধারে ঢুকে পড়েছি জঙ্গলে। ভিতরটা কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে। আর আবছা অন্ধকারে মোড়া। পা ফেলতে ভয় করছিল। সাপের ছোবল খাওয়ার ভয়। শুকনো পাতার উপরে সব সময়েই খড়খড় শব্দ করে কারা সব যেন যাচ্ছে আসছে। মাথার উপরে নানান জাতের পাখির মিষ্টি আওয়াজ। কিন্তু সেই মিষ্টি পরিবেশটাকে ভেঙে দিয়ে রুক্ষ মেজাজে ডেকে চলেছে একটা তক্ষক। হাওয়া নেই। অথচ থেকে থেকে ঝড়ে কাঁপার মত থরথরিয়ে খড়খড়িয়ে উঠছে ডালপালা। ভয় এবং আনন্দ দুটোই তখন ঘিরে ফেলেছে আমাকে। বিকেল থেকে আকাশটা মেঘলা। তাই সন্ধ্যে হওয়ার অনেক আগেই সন্ধ্যেবেলার অন্ধকার নেমে এল হঠাৎ। আর সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল বনের ভিতরের চেহারাটা। যদিও স্পষ্ট করে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবুও মনে হচ্ছিল যেন একটু আগের চেনা গাছগুলো এখন হয়ে গেছে দত্তি-দানবের মতো। তাদের লম্বা লম্বা নখ দুলছে, ঝুলছে যেন চারপাশে। হাঁটতে গেলেই মনে হয় কার গায়ে যেন গা লাগবে, অথবা হাঁটার পথটা যেন দলা পাকানো ডালপালা, শিকড়-বাকড়ে বন্ধ। পকেট টর্চ না-থাকার জন্যেই বেড়ে গেল ভয়টা। সুতরাং এমন ভূতুড়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়াই মঙ্গলের। হোঁচট খেতে খেতে, যতটা দ্রুত পারা যায়, হাঁটছি। একটু যেতে-না-যেতেই আমার সামনে লম্বা একটা মূর্ত্তি। মানুষের মতো, কিন্তু মানুষ নয়। একটা লম্বা রোগা টিংটিঙে মানুষ যদি পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা খুব স্বচ্ছ সাদা বোরখায় নিজেকে ঢেকে রাখে, যেমন দেখাবে, তেমনি। ভয়ে আমার গলা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল চাপা চিৎকার।
-কে?
-আমি স্যার, কালো…
—কে কালো?
—মনে নেই স্যার! কাল সকালে ফোনে…
এইটুকু শুনেই গলা কাঠ হয়ে গেল আমার। পা কাঁপছে। নিজেই শুনতে পাচ্ছি নিজের হৃৎপিণ্ডের ধ্যকধ্যকানি।
—কি কি কি দরকা কা কা র?
ততক্ষণে মনে মনে বুঝে গেছি কী দরকার ওর। এই জঙ্গলের মধ্যে ও আমাকে মড়মড় করে চিবিয়ে খাবে, আমি যদি ওকে সিনেমায় নামার পার্ট দিতে রাজী না হই। ঈস, কী কুক্ষণে ঢুকেছিলাম এই জঙ্গলে।
-স্যার! ভয়ের কিছু নেই। আপনার জন্যে টর্চ নিয়ে এলাম।
– টর্চ !
—হ্যাঁ স্যার! আলো দেখাচ্ছি, আমার পিছন পিছন আসুন, ই জঙ্গলটায় ঢুকে ভালো করেননি। ইটা খুনে জঙ্গল। আর যতো আত্যোহত্যা হয় ইখেনেই। মোদের অনেক আত্মীয়-স্বজোন ইখেনকার শ্যেওড়া গাছে, তেঁতুল গাছে বাসা নিয়েছে তো, তাই জানি সব ব্যাপার!
সত্যিই একটা টর্চ জ্বলছিল আমার সামনে। গোড়ায় যতটা ভয় পেয়েছিলাম, এখন যেন সত্যিই আর ভয় লাগছে না ততটা। কালোর ব্যবহারটা অবিকল একটা ভালো মানুষের মতো।
জিজ্ঞেস করলাম -তুমি আবার সিউড়ীতে চলে এলে কখন?
-সে কি স্যার। আমি তো আপনার সঙ্গে আপনার গাড়িতেই এলাম।
-আমার গাড়িতে? বল কি? কখন?
—আপনাদের গাড়ি বালি ব্রীজে উঠল যখন, তখন থেকেই আমি গাড়িতে।। ড্রাইভারের পাশে। মনে নেই স্যার, পাণ্ডুয়ার কাছে এসে আপনি চেঁচিয়ে উঠলেন, এ্যাই বিশু, সিগারেট ফুরিয়েছে, দৌড়ে এক প্যাকেট…বলেই তখ্যুনি দেখতে পেলেন বুক পকেটে ভর্তি সিগারেটের প্যাকেট। মনে পড়ছে। স্যার?
—হ্যাঁ। পড়ছে বটে।
—বুক পকেটের সিগারেটটা তো স্যার আমার এনে দেওয়া।
-তোমার? কি করে আনলে? গাড়ী তো থামেনি একবারও।
—গাড়িতে বসেই হাত বাড়িয়ে দিনু একটা সিগারেটের দোকানের দিকে।
—গাড়ি ছুটছে ৪০ মাইল স্পীডে। আর তুমি হাত বাড়িয়ে…
-দেখুন স্যার! অনেক জিনিস থাকার চেয়ে না-থাকা ভাল। আপনাদের হাত আছে। আর আছে বলেই তার একটা মাপ আছে। মদের হাত-পা নেই। তার মানে কি? হাত-পায়ের কোন ধরা বাঁধা মাপ নেই। আর নেই বলেই সেটাকে যখন যেমন দরকার, এক হাত, দশ হাত, এক মাইল, দশ মাইল লম্বা করে দিতে পারি।
দিনের আলোয় যখন ঢুকেছিলুম জঙ্গলটায়, তখন ছিল কতটুকু। এখন এত হেঁটেও ফুরোচ্ছে না কেন? কি ভেবেছে ও? নানান রকম মজার গল্প করে আমাকে এই জঙ্গলের মধ্যে ঘুরিয়ে ক্লান্ত করে তারপর…। তেষ্টায় গলা কাঠ। আর চারপাশের এই গুমোট গরমেও আমার হাড়-মাস শীতে ঠকঠক। মনে মনে রাম নাম জপতে জপতে চলেছি ওর পিছনে।
খানিক পরেই কানে এল মানুষের গলা। তারপরেই দূরের গাছপালার আড়াল ভেদ করে জ্বলে উঠল টর্চের আলো। আলোটা এগিয়ে আসছে আমার দিকেই। আর কোন্ ফাঁকে আমার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে সাদা মূৰ্ত্তিটা।
শক্তি, বিশু আর একজন স্থানীয় লোক টর্চ জ্বালিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল যখন আমার মুখ দিয়ে প্রথম কথা—
—তোমরা আর একটু দেরী করলে, মুচ্ছা যেতাম আমি।
-কেন, কেন?
-চলো গাড়িতে উঠি আগে। একটু জল খেতে হবে। পরে বলবো।
হোটেলে ফিরে খেয়ে-দেয়ে নিজের বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছি। বালিশের পাশে স্ক্রীপ্টের খাতা আর কলম। ঘুমোবার আগে চিত্রনাট্যটা মেরামত করে নেব একটু-আধটু। লোকেশন দেখার পর স্ক্রীপ্টের গড়ন-গঠনে অদল-বদল ঘটে যায় অনেক।
সিগারেট শেষ। স্ক্রীপ্টের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখি, কলম আছে, অথচ স্ক্রীপ্টের জলজ্যান্ত লম্বা-চওড়া খাতাটা উধাও। তাহলে কি বিশু খাতাটা দিতে ভুল করেছে? আমি বিশুকে হাঁক দিতেই আমার ঘরের সংলগ্ন ছোট্ট অন্ধকার বারান্দার দিক থেকে অদ্ভুত খনখনে গলায় সাড়া এল—
—স্যার, খাতাটা আমার কাছে। একটু দেখতেছি চোখ বুলিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, আজকের রাত্রিটা জেগেই কাটাতে হবে আমাকে। সারারাত ওর সঙ্গে বকর বকর করা মানে, ঘুমের বারোটা। আবার একটা সিগারেট ধরালাম আমি। ভাগ্যিস আলোটা জ্বলছে। নইলে এমনও তো হতে পারতো যে, ও আমার বুকের উপরে চেপেই স্ক্রীপ্টের খাতাটা নিয়ে বসে গেছে পড়তে। আর ওর ছোঁয়ায় ক্রমশ হিম হতে হতে, কোনো এক সময় মরে গেলাম আমি।
তবে এটাও ঠিক, আগের চেয়ে ওর সম্পর্কে আমার ভয়ের মাত্রাটা কমে গেছে অনেক। কেন জানি না, এটা আমার বিশ্বাস হয়েছে যে, ও সত্যিই আমাকে শ্রদ্ধা করে। তবে এটা জানা যায়নি, শেষ পর্যন্ত ওকে ছবিতে কোন পার্ট না দিলে ও ঠিক কী ভাবে ক্ষতি করবে আমার। শরীর থেকে সমস্ত রক্ত চুষে নেবে এক নিমিষে, নাকি শুধু ঘাড়টাকে মটকে দিয়েই দৌড়ে পালাবে। তা ছাড়া ভূতেরা সত্যিই মানুষ খায় কিনা, খেলে কি ভাবে খায়, এমনকি সরাসরি ভূতের খপ্পরে পড়লে মানুষ আত্মরক্ষা করবে কী ভাবে, এ সম্বন্ধে মানুষ আজ পর্যন্ত কোনো গভীর গবেষণা করেনি বলেই, মানুষ রয়ে গেছে ভূতের মতো কালো অন্ধকারে।
এই সব ভাবনার ফাঁকেই হঠাৎ মাথায় এসে গেল একটা বুদ্ধি। এমন বুদ্ধি যাতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।
-কালো -ও
-বলুন স্যার!
—অত বড় স্ক্রীপ্ট তোমার পড়ার দরকার নেই। আমি তোমার জন্যে একটা নতুন চরিত্র তৈরী করেছি। কাল রাত্রে এসে দেখা করো। সংলাপটা দিয়ে দেবো।
বলামাত্রই অনুগত ভৃত্যের মতো সে পালন করল আমার আদেশ। সঙ্গে সঙ্গেই চিত্রনাট্য আমার বিছানায়।
—স্যার, মশারীটা টাঙি দুবো।
—না, থাক।
সে চলে গেল, এটা বুঝতে পারলাম জানলার পর্দার বিনা হাওয়ায় দুলে ওঠা দেখে।
পরের দিন রাত্রে যথাসময়ে ও আসতেই সংলাপের কাগজটা নিয়ে ও চলে গেল। তারপর থেকে কোনদিন ওর সাড়া পাইনি। পাব না, সেটাও জানতাম। কেননা যে-সংলাপ ওকে দিয়েছি, তার মধ্যে আঠারো বার রয়েছে ‘রাম’ শব্দটা। যেমন আরাম, ব্যারাম, হারামজাদা, রামতনুবাবু, অবিরাম, রামধনু, রামায়ণ, বিরাম, রামরাজ্য, ভ্যবাগঙ্গারাম ইত্যাদি ইত্যাদি। আর প্রথম দিনে টেলিফোনের আলাপে ও তো নিজেই স্বীকার করেছে, ভূতেদের রামনাম উচ্চারণ করা বারণ।
মাস চারেক পরের ঘটনা। ছবির শুটিং শেষ। প্রথম দফার প্রিন্ট এসেছে বোম্বে থেকে আজই। আমরা বসেছি প্রজেকশন দেখতে। সাইলেন্ট রাশ। ছবি চলছে। ক্যামেরাম্যান শক্তি বসেছিল আমার পাশেই। হঠাৎ একসময় সে আমার দিকে তাকাল।
—এটা কি করে হল বলুন তো?
– কোনটা?
—গয়নার দোকানে আমরা যে মিড শট নিয়েছিলুম, তাতে তো তিনজন ছাড়া আর কেউ ছিল না। অথচ…
—অথচ ?
—অথচ এখানে দেখছি আরো একজন লম্বা মতন লোক দাঁড়িয়ে আছে ফ্রেমের ঠিক মাঝখানে। তা ছাড়া সেন্টার অব দা ফ্রেমে থেকেও লোকটা আউট অব ফোকাস। আমি তো এভাবে শট নিইনি।
—তাই নাকি? প্রজেকশন বন্ধ করে আবার চালাতে বলতো।
ছবি আবার শুরু হল গোড়া থেকে। ফিরে এল গয়নার দোকানের দৃশ্য। চোখটাকে জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। তা ছাড়া দৃশ্যটা আসার মুহূর্তে ইঙ্গিতও করেছিল শক্তি। দেখলাম, ঠিকই বলেছে শক্তি। চতুর্থ একটা চরিত্র কোথা থেকে ঢুকে পড়েছে ফ্রেমে।
-কি ব্যাপার বলুন তো!
শক্তির চোখে-মুখে প্রচণ্ড বিস্ময়। ওর টেনশন কমানোর জন্যে বললাম—
–ঠিক আছে, দেখে যাও। পরে কথা বলবো।
ছবি দেখা শেষ। বাড়ি ফিরে এসে শুয়েছি। রাত তখন প্রায় একটা। হঠাৎ ঝন্ ঝন্ করে বেজে উঠল চার মাসের মরা টেলিফোন। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়েই খুঁজে নিলাম টেলিফোনটা।
-হ্যালো!
—স্যার! আমি। আজ তো পোজেকশন দেখলেন?
—হ্যাঁ, দেখলাম।
—আপনি আমার উপর রাগ করেছেন স্যার? আমার কোনো দোষ নেই। আপনি যে ডাইলক দেছিলেন, সে-সব বলতে পারবো নি দেখেই, ঢুকে পড়েছি অন্য একটা দিশ্যে। আমার ওভিনয় কেমন লাগল স্যার?
রিসিভারটা হিম হয়ে আসছে আবার।
—পরের ছবিতে একটু ভালো ডাইলক দিবেন স্যার মনে করে।
রাগে হাত পা কাঁপছিল আমার। কোনো উত্তর না দিয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলুম তখুনি। অন্ধকার ঘরের স্তব্ধতায় আচমকা একটা বাজ পড়ার মতো শব্দ হল যেন।
টেলিফোনের ঝনঝনানিতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল আমার স্ত্রীর। বিছানায় ফিরে আসতেই তার প্রশ্ন—
–কার ফোন?
— সেই কালোপনিক ভূতের।