বই রিভিউ ও ডাউনলোড

শঙ্খনীল কারাগার রিভিউ – হুমায়ুন আহমেদ

বইয়ের নামঃ শঙখনীল কারাগার
লেখকঃ হুমায়ুন আহমেদ
ক্যাটাগরিঃ উপন্যাস
মুদ্রিত মূল্যঃ২০০ টাকা
গল্প শুরু হয়েছে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন কথা নিয়ে। গল্প শুরু হয়েছে খোকাকে দিয়ে এক বর্ষণমুখর রাতে। খোকাসহ তার ভাই-বোনেরা তার মাকে খুব ভালোবাসতো কিন্তু তার মা তাদের কেমন যেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাবে দেখতো। শুধু তাদের বড় বোন রাবেয়াকে বড়ই বেশি ভালবাসতো। খোকা সহ সকল ভাই-বোনেরা তার মায়ের রং পেয়েছিল। রাবেয়া টা একটু অন্যরকম, অন্যরকম বলেই হয়তো মা অন্য চোখে দেখতেন, হয়তোবা।
এরকমই এক রাতে খোকার মন চাইল ঝড় বৃষ্টি যেন তাদের মধ্যে থাকা সকল দুঃখ কষ্ট দূরে উড়িয়ে নিয়ে যায়,দূর বহুদূরে। ঘড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে সময় দেখতে পারছে না খোকা। বাড়ির মুখে মন্টুকে দেখতে পেলো খোকা, মুখ লাল করে বসে আছে। বাসায় তাহলে সমস্যা হয়েছে কিন্তু সমস্যাটা কি? ঝুনু কি গ্লাস ভেঙে ফেলেছে? মন্টুকে নিয়ে বাড়ির পথে গেল খোকা।বাড়ি পৌঁছে দেখল মা অসুস্থ, মায়ের পেটে

ব্যথা হচ্ছে। খোকা ভাবলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ হয়তো এসে পড়েছে, হয়তো এখনই তাদের ঘর আলো করে আসবে কোন ফুটফুটে ছেলে কিংবা মেয়ে সন্তান কিন্তু তার আসার আগে ভীষণ ভয় করছে খোকার। খোকা পাশের বাসা থেকে ফোন দিলো তার বাবাকে। বাবা খবর পেয়ে দেড় ঘন্টা পরে চলে আসলেন বাসায়। বাবার মনে ভীষণ ভয়। মনটা যেন খালি নাই নাই বলছে। রাবেয়া টা অনেক খাটছে। মিনিটে মিনিটে এসে জিজ্ঞেস করছে কিছু খাব কিনা? খোকার রাত হলেই মাথা ব্যথা করে। হয়তো পুরো দিনের চাপ শরীরের সব অঙ্গ সহ্য করতে পারলেও মাথাটা নেহাত অসহায়। এভাবেই রাত শেষে ভোর হয়ে গেল। যে দাঈ আনা হয়েছিল সে হাসপাতালে নিতে বলল মাকে। বাবা সায় দিল। বাবা তাই মাকে নিয়ে গেল এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে। খোকা বাসায় আসলো, বসলো ইজিচেয়ারটায়।

মন্টু বেচারা ভীষণ আবেগি। মন্টু এম্বুলেন্স এর পিছু পিছু হাসপাতালে গেল। খোকা ভাবতে থাকলো মৃত্যুর চেয়ে জন্ম হওয়া অনেক কঠিন। মায়ের পেটে কোন দারিদ্রতার ছোঁয়া লাগে না। কিন্তু মায়ের পেট নামক সেই রক্ষাকবচ থেকে বের হয়ে গেলে দারিদ্রতার ছোঁয়া লেগে যায়। নিষ্পেষিত হয়ে পড়ে মানুষ দারিদ্রতার করাল ছায়ায়। এরকম সক্রেটিস মার্কা ভাবনা ভাবতে ভাবতেই খোকার মনে পড়ল অনেকদিন কলেজে যাওয়া হয়নি। চা খেয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো খোকা। হয়তো এই পা ক লেজ শেষে যখন আবার এই বাসায় ফিরবে তখন তাদের পরিবারে আরও একজন সদস্য এসে যাবে। সেও হয়তো এই নিলিপ্ত নির্বিবাদী দরিদ্র পরিবারের সদস্য হয়ে যাবে। হয়তো, হয়তো বা। বন্ধুর প্রেম পত্রের কথা শুনতে শুনতে সময় যে কোথা থেকে চলে গেল খোকা টেরই পেল না। খোকা বাড়ি আসতেই তার পাশের বাসার এক কাকা তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে বলল। খোকার দুই পা জন্য মাটির ভেতরে গেঁথে গেল, হয়তো সে গাছ হয়ে গিয়েছে, আর কোন স্বাভাবিক চলন তার পক্ষে সম্ভব না।
কোনো মতে রিকশায় উঠে চলে গেল হাসপাতালে। হাসপাতালে যেয়ে খালার সঙ্গে খোকার দেখা। খালার কোলে ছোট্ট একটি মেয়ে বাবা দেয়ালের সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। রাবেয়া অঝোরে কান্না করছে, অধিক শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে। খোকার আর বুঝতে বাকি রইল না কি ঘটে গিয়েছে? কী দুঃসহ যন্ত্রণা! কি কষ্ট! একবার খোকা জিজ্ঞেস করেছিল তার মাকে মা তুমি কেন রাবেয়াকে শুধু ভালোবাসো? মা বলেছিল মুচকি হেসে খোকা আমি তোমাদের এমন ভাবে মানুষ করেছি যাতে তোমরা কষ্টে ভালো থাকতে শেখো। কেউ চলে গেলে হয়তো তার রেশ রেখে যায়। সেই অংশই আঁকড়ে রাখতে চাই আমরা খোকা ভেবেছিল মাতৃশোক সে সারাজীবন বহন করে যাবে কিন্তু তা হলো না। আহ কি সুন্দর প্রকৃতি! কি সুন্দর সাম্যতা প্রকৃতির! দেড় মাস পরে তাদের সে দরিদ্র পরিবার আবার যেন আগের মত হয়ে গেল। ফিরে পেল তাদের খেলাচ্ছলতা।
তাদের ছোট বোনটির নাম দেওয়া হল নিলু।খুব সুন্দর হয়েছে দেখতে । খোকার এইটুকু জীবনে দুই একটা ধ্রুবতারার মধ্যে একটি ছিল তার খালাতো বোন কিট কি। রাবেয়া ওদের নিয়ে প্রায়ই ব্যঙ্গ করত। রাবেয়া বেচারা কালো বলে প্রতিনিয়ত কটু কথা শুনতে হয় তার মানুষের কাছ থেকে। রুনুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল একপর্যায়ে। পরে জানতে পারা গেল রুনু সবুজ নামের কোন ব্যক্তিকে প্রেমপত্র লিখেছিল। ভেঙে গেল রুনুর বিয়ে। পরে ঝুনুর বিয়ে হয়। রুনু ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে গেল। হঠাৎ করে সে পাগলামি করতে থাকলো। সে হাসতে থাকলো, সে হাসাতে থাকলো। আসলে কি মানুষ বদলে যায়?যে বাবা হাসিমুখে কথা বলতে পারতো না সে কি না দিনের পর দিন কথা বলে চলল। ভাবতেই অবাক লাগে। মানুষ বড়ই অবাক প্রা। এই কাঁদে এই হাসে। খোকার মধ্যে এই পৃথিবীর সবাই কবি। কেউ কবিতা লেখে কেউ কবিতা লেখে না, তবুও এই পৃথিবীর সবাই কবি। একে একে এই পরিবারে গৃহকর্তী মা মারা গেল, মারা গেল তাদের আদরের বোন রুনু,বিয়ে হয়ে গেল ঝুনুর, এমনকি বাচ্চা ও হয়ে গেল। সময় পাল্টে গেল, শুধু পাল্টেনি একটি জিনিস। সেটা হলো খোকাদের দারিদ্রতা।রাবেয়া কই জানি গিয়েছে? বন্ধুদের সাথে হয়তবা, খোকা হাসিমুখে বিদায় দিয়েছে রাবেয়াকে। হঠাৎ একদিন চিঠি এলো। বড় বড় অক্ষর। একটি গল্পের মত লেখা। কিরে খোকা? কেমন আছিস? টাকার কষ্ট বেশি নাকি ক্ষুধার কষ্ট? শুধুশুধু জিজ্ঞেস করলাম। এই ছোট্ট একটি চেক পাঠালাম। খুলে দেখিস। কেমন লাগলো? আমাকে একজন প্রায়ই বাসায় বিদেশি চক লেট দিয়ে যেত না। মনে আছে তোর? হ্যাঁ আমি আবিদ হাসানের কথা বলছি। মনে থাকার কথা হয়তো তোর না, তাও বলছি। আমি সেই আবিদ হাসান এর মেয়ে। হয়তো এটা আমার পরিচয় না। হয়তো তুই আমাকে চিনিস না? আসলে তুই আমাকে চিনিস, অনেক ভালো মতই চিনিস। আমি তোদের সেই রাবেয়া।
বলতাম না তোদের আমি সব জানি। আমার মা মানে তোদের ও যে মা তার প্রথম বিয়ে হয়েছিল আবিদ হাসান এর সঙ্গে। পরবর্তী বিয়ে ভেঙে যায়। তারপর তোর বাবার সাথে আমিও যাকে বাবা বলে ডাকি তার সাথে মায়ের বিয়ে হয়। একে একে জন্ম নিস তোরা। তোরা সবাই সাদা,আমিই শুধু একটা কাকের মতো কালো। সত্যি বলছি সত্যি তিন সত্যি বলছি আমি বাবার মতো বাবা কোনদিন দেখিনি। সে একটিবারও তোদের জানায়নি আমার আসল পরিচয়। আমি রাবেয়া, আমিতো দেশেই কৃষ্ণবর্ণের রাবেয়া।
গল্পের এক পর্যায়ে খোকার মনে হল ইস ১০০ টি ফানুস যদি থাকত। তাহলে সবগুলো ফানুস উড়িয়ে দিত। উড়ে যাক দারিদ্রতা, উড়ে যাক দীনতা, আসলেই আমরা কারার কাননে বন্দী। আমরা বন্দী সেই শঙ্খনীল কারাগারে। কারাগার কবে মুক্তি পাবে খোকা সেটা জানে না। খোকা আমাদের আশেপাশের খোকারা এভাবেই দিনাতিপাত করে। ভাবতেই অবাক লাগে। এত দুঃখ কষ্টের মাঝেও কিভাবে তাদের জীবনে খেলাচ্ছলতা থাকে? কি অদ্ভুত তাদের জীবন! খোকার সে দুঃখ কষ্টের জীবনে হয়তো সুখ আসলো কিন্তু খোকা কখনো সুখ একা ভোগ করতে চাইনি। খোকা চেয়েছিল সুখ সকলকে নিয়ে ভাগাভাগি করতে। কই? কোথায় চলে গেল তারা? কোথায় চলে গেল আমাদের মা? কোথায় চলে গেল আদরের বোন রুনু? ঝুনু বিয়ে করে চিটাগং চলে গিয়েছে। এখনই কারাগারে হয়তো সুখ এসে পড়েছে কিন্তু লোক ছাড়া এই কারাগার যেন শূন্য। এই শূন্যতার শঙ্খনীল কারাগারে একাকী সৈনিক খোকা। খোকার এখন বড্ড ইচ্ছে করে একশোটা মশাল হাতে নিয়ে দূরে বহুদূরে উড়িয়ে দিতে। আচ্ছা 100 টি মশাল মার কাছে পৌঁছাবে? রুনুর কাছে পৌঁছালেও হবে। প্রশ্ন থেকে যায়? মশাল পৌঁছাবে কি? পৌঁছাবে না কিন্তু আমাদের হৃদয়স্পর্শী ভালোবাসা পৌঁছে যাক হুমায়ূন আহমেদের কাছে তার অনবদ্য সৃষ্টি শঙ্খচিল কারাগার এর জন্যে।আশেপাশের মানুষ কারাগারের ভেতরে যতই অর্থ পাক যতই অন্ন পাক, যতই বস্ত্র পাক, যতই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাক তবুও তারা কারাগারকে কারাগার ই মনে করে। খোকার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না। খোকা সেজন্য এখনো মনে করে সে কারাগারে বন্দী। হয়তো এই কারাগারেরই নাম শঙ্খনীল কারাগার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button