যৌতুক প্রথা অনুচ্ছেদ রচনা
ভূমিকাঃ আমাদের দেশে নানাবিধ সামাজিক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে যৌতুক প্রথা। একে কেন্দ্র করে আমাদের বাংলাদেশের যেসব হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে তার কিছু সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশ পায় মাত্র। কিন্তু এর অন্তরালে যে সকল খবর রয়ে যায় তা সমাজকে বিষময় করে তোলে। বিপন্ন হয় নারীর সামাজিক জীবন।
সাধারণভাবে বলা যায়, যৌতুক হচ্ছে একটি সামাজিক কুপ্রথা। এ প্রথায় কন্যার বিয়েতে বরপক্ষকে নগদ অর্থ প্রদান করতে বাধ্য করা হয়। ইতি কন্যার পিতা মাতার আর্থিক সঙ্গতির কথা বিবেচনা করা হয় না। এটা নির্যাতনমূলক প্রথা যাবি এরপর পবিত্রতা রক্ষা করেন।
যৌতুকপ্রথার উৎপত্তি: যৌতুকপ্রথার উৎপত্তি হয় হিন্দুসমাজ থেকে। হিন্দু আইনে পিতার সম্পত্তিতে কন্যার উত্তরাধিকার স্বীকৃত নয়। তাই কন্যা পাত্রস্থ করার সময় নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার প্রভৃতি দ্রব্যসামগ্রী দেওয়ার প্রচলন বহুকাল ধরে রয়েছে। এ ছাড়াও আদিতে বর-কন্যার নতুন সংসার সাজাতে উপহারসামগ্রী দেওয়া হতাে। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে এই উপহারপ্রথা যৌতুকপ্রথাতে রুপ নিয়েছে। এছাড়াও মুসলিমসমাজে পণপ্রথা প্রচলিত ছিল। এখনও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলােতে পণপ্রথা প্রচলিত। পূর্বে কন্যাপক্ষকে পণ দিয়ে পাত্রপক্ষ বিয়ে করত। কিন্তু বর্তমানে এই ধারার পরিবর্তন হয়ে বরপক্ষ কন্যাপক্ষের কাছ থেকে দরকষাকষির মাধ্যমে যৌতুক গ্রহণ করে। উনিশ শতকে রামমােহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম সচেতন হন। তারা এই প্রথা রােধ করার জন্য আইন পাশ করেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮০ সালে যৌতুকনিরােধ আইন প্রণয়ন করেছে। তবুও এই প্রথা রােধ করার প্রচেষ্টা সর্বাংশে সফল হচ্ছে না। তবে শিক্ষিত উচ্চবর্গের মানুষের মধ্যে এই প্রথা ধীরে ধীরে বর্জিত হচ্ছে। অপরদিকে, ধর্মীয় বিধান অনুসারে পাত্রীকে দেওয়া বরের দেনমােহর বা মােহরানা যৌতুক হিসেবে গণ্য করা হয় না। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে লক্ষণীয় যে, পাত্রের সাধ্যের কথা অনেক ক্ষেত্রে বিবেচনা না করে পাত্রীপক্ষ পাত্রপক্ষের কাছে অধিক দেনমােহর দাবি করে। দর কষাকষির ফলে এটিও অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের পবিত্রতা নষ্ট করে। যৌতুকপ্রথার কারণ : বাংলাদেশে
যৌতুকপ্রথার কারণ: সমাজব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবােধ, অসমবণ্টন ব্যবস্থার প্রকৃতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে যৌতুকপ্রথা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। তার মধ্যে গণদারিদ্র্য, পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের অবজ্ঞা, অবহেলা, আভিজাত্য ও সামাজিক মর্যাদালাভের আকাঙ্গা, যৌতুক প্রদানের ক্ষেত্রে অহমিকা প্রকাশ, নারীসমাজের নিরাপত্তাহীনতা ও পরনির্ভরশীলতা, কনের বয়স ও সৌন্দর্যের অভাবের কারণ প্রভৃতি এদেশে যৌতুকপ্রথার জন্য দায়ী বলে মনে করা যায়।
যৌতুকপ্রথা দূরীকরণের উপায় : যৌতুকপ্রথা বাংলাদেশের কেবল প্রধান সমস্যাই নয়, অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয় এই প্রথা থেকেই। যে-সমাজ প্রতিটি মানুষের কাজ, শিক্ষা, আশ্রয়, নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারবে, সেই সমাজে যৌতুকপ্রথা থাকতে পারে না। নারী পণ্য নয়, বিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যম নয়, নারীও মানুষ, সমাজে তাদের সমমর্যাদার অধিকার আছে- এই ধারণা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তাই যৌতুকপ্রথা রােধ করার জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত মহিলাদের অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা বিধান, যৌতুক দাবি করা পরিবার ও ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে বয়কট করা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার আদর্শ প্রচার করা, নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরা করা, নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সম্প্রসারণ ঘটানাে এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতিত নারীকে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হলে এই প্রথা রােধ করা সম্ভব বলে ধারণা করা যায়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, দারিদ্রপ্রধান দেশে দারিদ্রই সকল সমস্যার মূল। দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবধতা ইত্যাদি দূর করে এই প্রথা বিলােপ করার সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে। কবি নজরুলের এই বােধসবার মনে জাগ্রত হতে হবে- পৃথিবীতে যা কিছু মহান চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।