ডিজিটাল বাংলাদেশ অনুচ্ছেদ রচনা
সূচনাঃ ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে সেই সুখী, সমৃদ্ধ, শিক্ষিত জনগােষ্ঠীর বৈষম্য, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ, যা প্রকৃতপক্ষেই সম্পূর্ণভাবে জনগণের রাষ্ট্র এবং যার মুখ্য চালিকা শক্তি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। এটি বাংলাদেশের জনগণের উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা। এটি বাংলাদেশের সকল মানুষের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়ােজন মেটানাের প্রকৃষ্ট পন্থা। এটি একাত্তরের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের রূপকল্প। এটি বাংলাদেশের জন্যে স্বল্পোন্নত বা দরিদ্র দেশ থেকে সমৃদ্ধ ও ধনী দেশে রূপান্তরের জন্যে মাথাপিছু আয় বা জাতীয় আয় বাড়ানাের অঙ্গীকার। এটি বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সােপান। এটি হচ্ছে একুশ শতকে জাতির জনক বন্ধবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সােনার বাংলা।
জাতীয় অগ্রাধিকার : ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম জাতীয় অঙ্গীকার হচ্ছে ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করে দেশ থেকে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করে জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যে জাতীয় পর্যায়ে অবকাঠামােগত অগ্রাধিকার থাকতে হবে সারাদেশের সকল ঘরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারা। একই সাথে প্রতিটি ঘরকে তার বা বেতার পদ্ধতিতে ডিজিটাল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় যুক্ত করতে হবে। এছাড়াও দেশের সকল অঞ্চলের জনগণের প্রত্যেককে ডিজিটাল যন্ত্রে সজ্জিত করা সহ ডিজিটাল ডিভাইড দূর করা জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে গণ্য হবে। জনগণের নিজস্ব সংযুক্তি এবং সরকারের সাথে জনগণের সংযুক্তির পাশাপাশি সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর ও ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্যে উপযুক্ত মানবসম্পদ তৈরি করা এবং কৃষি, শিল্প ও ব্যবসার রূপান্তর অগ্রাধিকার হিসেবে গণ্য হবে।
বাস্তবায়নের লক্ষ্য : ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হচ্ছে, এটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্তরে স্তরে এর অনুন্নত জীবনধারাকে বদলে দিয়ে বাংলাদেশের সমাজকে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তর করা। কার্যত এদেশের মানুষের জীবনযাপন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবস্থাপনা, কর্মপদ্ধতি, শিল্প-বাণিজ্য ও উৎপাদন, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা এবং জনগণের সরকারসহ সমাজের সকল স্তরের সকল কাজকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর হলাে ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কিছু রাজনৈতিক লক্ষ্যও রয়েছে। সেসব লক্ষ্যকে খুব সংক্ষেপে এভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে।
ক. জনগণের রাষ্ট্র : ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য হবে বাংলাদেশকে একটি জনগণের রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এ রাষ্ট্রটি হবে প্রকৃতপক্ষেই জনগণের। এর রূপরেখার ভিত্তি হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ঘােষণা। এ রাষ্ট্রে ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণের উন্নত জীবনযাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পাশাপাশি মৌলিক মানবিক অধিকার সংরক্ষণসহ সকল সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার সকল প্রকারের নিশ্চয়তা থাকবে। এ রাষ্ট্রের সকল স্তরে বৈষম্যহীনভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে এবং জনগণের কাছে এই প্রযুক্তি সহজলভ্য ও সুলত করা হবে।
খ. মৌলিক চাহিদা রাষ্ট্রকেই পূরণ করতে হবে : রাষ্ট্রকে জনগণের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ, অন্ন-বস্ত্র- বাসস্থান-শিক্ষা ও চিকিৎসার ন্যূনতম দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। জনগণ যাতে তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার মতাে উপার্জন করতে সক্ষম হয় তার জন্যে তাকে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার শেখাতে হবে এবং সেই প্রযুক্তি তার কাছে রাষ্ট্রকেই সহজলভ্য করতে হবে। দরিদ্র জনগণকে জ্ঞানকর্মী বা ডিজিটাল প্রযুক্তিকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং গ্রামে গ্রামে জানভিত্তিক অর্থনীতি, মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক শিল্প-বাণিজ্যসহ কৃষি, শিক্ষা, টেলিযােগাযােগ ইত্যাদি খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে প্রয়ােগ করতে হবে। সমাজে পেশীশক্তির প্রভাবের বদলে জ্ঞানশক্তির প্রভাব বিরাজ করবে। দারিদ্র্য দূর করা, জীবনমান উন্নত করা, সকল জনগণকে ডিজিটাল যুগের শিক্ষা প্রদান করা, সকল নাগরিকের জন্যে সমান সুযােগপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং উন্নত আয়ের ডিজিটাল জীবনধারা প্রতিষ্ঠা করাসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রের বৈষম্য দূর করাসহ সকল ধরন ও প্রকারের ডিজিটাল ডিভাইড দূর করতে হবে।
গ. রাজনীতির ডিজিটাল ধারা ; ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য হচ্ছে সরকার ও জাতীয় সংসদসহ সকল রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবস্থা ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালিত করা এবং রাজনীতির ডিজিটাল ধারা প্রতিষ্ঠা করা। জনগণ এ পদ্ধতিতে সকল সময়েই সংবাদ, সরকার ও রাজনীতিতে ইন্টারএ্যাকটিভ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
কর্মসূচি : ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠা করে সরকারের কাজ করার পদ্ধতি ডিজিটাল করা এবং বিচারব্যবস্থা, ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থাসহ সরকারের সকল কাজকে রূপান্তর করা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মাঝে রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিজিটাল করা। শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিতে রূপান্তর করা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার একটি অগ্রাধিকার। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর করে বিদ্যমান আর্থিক কাঠামােকে জ্ঞানভিত্তিক মেধাকেন্দ্রিক সৃজনশীল অর্থনীতি গড়ে তােলা ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য। ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে অর্থ ও শারীরিক শক্তির বদলে মেধা ও জ্ঞানের শক্তির প্রাধান্য থাকবে। কৃষিভিত্তিক একটি সমাজ থেকে বাংলাদেশ একটি সৃজনশীল ও মেধাভিত্তিক শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়ে মানবসভ্যতার ডিজিটাল যুগে নেতৃত্ব দেবে। অধিকতর হবে সেবা খাতে। জাতীয় আয়ের বৃহদাংশ আসবে মেধাজাত খাত থেকে।
সতর্কতা : সারা দুনিয়াতেই ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসারের ফলে ডিজিটাল ডিভাইড তৈরি ও সম্প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশে। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে এর প্রভাব হিসেবে বিদ্যমান ডিজিটাল ডিভাইড আরও সম্প্রসারিত হতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযােগ-সুবিধাভােগী, শােষকগােষ্ঠী, ধনী বা বিশেষ সম্প্রদায় শ্রেণি-গােষ্ঠীর জন্যে আরাে বেশি সহায়ক হতে পারে। এমনকি জ্ঞানভিত্তিক সমাজে জ্ঞানহীন বা জ্ঞানী হবার সুযােগহীন মানুষের জীবনযাপন আরাে কষ্টকর হতে পারে। সেজন্যেই ডিজিটাল ডিভাইড না রাখাটা ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি লক্ষ্য হতে হবে।
রূপকল্প ২০২১ঃ ‘রূপকল্প ২০২১’ হচ্ছে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের ও প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার চূড়ান্ত সময়কাল। এগারাে বছর মেয়াদি (২০১০-২০২১) একটি প্রেক্ষিতে পরিকল্পনা (ণেৱণর্ডধশণ যফটড) এবং এর ওপর ভিত্তি করে যষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কাঙিক্ষত এ রূপকল্প অর্জিত হবে।
রূপকল্পের বাংলাদেশ : রূপকল্পের বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন। যেখানে সভাব্য উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম একটি দ্রুত বিকাশমান প্রকৃত অংশীদারিত্বমূলক সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার, নারীর অধিকার ও সুযােগের সমতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন, দূষণমুক্ত পরিবেশ। সেই বাংলাদেশে স্থিতিশীল থাকবে দ্রব্যমূল্য, আয়-ব্যয় ও দারিদ্র্য নেমে আসবে ন্যূনতম পর্যায়ে, সবার জন্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত হবে, ব্যাপকভাবে বিকশিত হবে মানুষের সৃজনশীলতা ও সক্ষমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে, হ্রাস পাবে সামাজিক বৈষম্য, প্রতিষ্ঠা পাবে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় মােকাবেলার সক্ষমতা। তথ্যপ্রযুক্তিতে বিকশিত হয়ে সেই বাংলাদেশ পরিচিত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে।
রূপকল্পের পথ : প্রেক্ষিত পরিকল্পনাঃ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২০২১ সালব্যাপী একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পরিকল্পিত, সুষম ও সমন্বিত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে ২০২১ সালের রূপকল্পের যপ্ন পূরণের ঈপিত লক্ষ্য অর্জনের পথপরিকল্পনা হলাে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ষষ্ঠ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১১-২০ অর্থবছরে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং এর সাথে সাথে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন নীতি, কৌশল, পরিকল্পনা, কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রেক্ষিত পরিকল্পনাটি (২০১০-২০২১) সম্পাদিত হবে। মূলত এটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন কাঠামাে এগিয়ে নেয়ার একটি নকশা। যার মাধ্যমে ২০১১ সাল নাগাদ দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রেক্ষিত পরিকল্পনার (২০১০-২০২১) কার্যক্রমের প্রধান প্রধান দিক হচ্ছেঃ
- * বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক, সহনশীল, উদার, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত করা
- * সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নির্মূল করা
- * টেকসই মানব উন্নয়ন * দূরদর্শী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তন
- * পরিকল্পিত ও গ্রহণযােগ্য শিল্পায়ন * পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা
- * খাদ্য নিরাপত্তায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন
- * পর্যাপ্ত অবকাঠামাের উন্নয়ন এবং
- * ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।