বই রিভিউ ও ডাউনলোড
অনুভূতির অভিধান বই রিভিউ – তাহসান খান
বই : অনুভূতির অভিধান
লেখক : তাহসান খান
প্রকাশনি : অধ্যয়ন
প্রকাশ : মার্চ ২০২১
মূল্য : ২৭০ (মুদ্রিত)
পৃষ্ঠা : ১২০
“যেকোনো সৃজনশীল মানুষের জীবনে সবচেয়ে কঠিন সংগ্রামটা হলো তার আশপাশের মানুষের কাছ থেকে তার কাজের বৈধতা অর্জন করা।”
বাংলাদেশে মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে যে কয়জন ব্যক্তিগত জীবনে কাজকর্মে স্মার্ট, শালীন ও পরিপাটি তাদের মধ্যে তাহসান খান অন্যতম। একাধারে গায়ক, সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা, উপস্থাপক, শিক্ষকসহ বহুমাত্রিক কাজে তিনি সফলতা অর্জন করেছেন। এবার জুড়িতে নতুন করে নামের পাশে যোগ হলো ‘লেখক’। তবে অন্যসব শাখার মতোই লেখক হিসেবে সফল হবেন কিনা তা হয়ত ভবিষ্যতই নির্ধারণ করে দিবে।
উনার গানের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। তারপর অভিনয় ও উপস্থাপনা। প্রতিটি কাজে মুগ্ধ। তাই ব্যক্তিগত ভালোলাগার জায়গা থেকে ‘অনুভূতির অভিধান’ বইটি পড়ার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। যথারীতি বইটি সংগ্রহ করে ফেললাম।
বইটিতে ২০টি অনুভূতির কথা তুলে ধরেছেন। প্রতিটি অনুভূতি তার ব্যক্তিগত কোন গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরি। প্রতিটি অনুভূতির গল্প শেষে রয়েছে একটি করে কবিতা। অনুভূতি ও কবিতার মাঝে রয়েছে একটি করে চমৎকার ইলাস্ট্রেশন।
বইয়ের একটা ইন্টারেস্টিং টপিক হলো ঈর্ষা। ঈর্ষাকে আমরা উপর থেকে ঈর্ষা হিসেবে
দেখি কিন্তু এটির যে ২টি দিক থাকতে পারে তা আমরা চিন্তা করি না। প্রথম দিক নিরাপত্তাবোধের অভাবে দ্বিতীয়টি হীনমন্যতার কারণে। লেখকের ভাষ্যমতে, আমার যা আছে তা হারানোর ভয় যখন আমার মাঝে জেঁকে বসে তখন আমি ঈর্ষা অনুভব করি। যেমন একজন নারী তার স্বামীকে অন্য কোনো নারীর সাথে একা কোনো রেস্টুরেন্টে বসে খেতে দেখলে ঈর্ষা হয়।এ দৃশ্যে আপনার মাঝে একটা নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে যে কোন সময় আপনার ছেড়ে চলে যেতে পারে, আবার অন্যদিকে আপনার সঙ্গীকে আপনি যা যা প্রমিজ করছেন তা দিতে পারছেন না, অন্য কেউ হয়ত পারছে এখন তাকে দেখে আপনার ঈর্ষা হবে। কারণ আপনি যা দিতে পারছেন না তা অন্য কেউ দিতে পারছে তা দেখে তার প্রতি ঈর্ষা হবে। আর এ ঈর্ষা আত্ন-হীনমন্যতার জায়গা থেকে হবে।
অনেক মানুষ আছেন যারা যে চাকুরি চেয়েছে সে চাকুরিটা-ই পেয়েছে। যখন যা চেয়েছে তখন তা-ই পেয়েছে। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে একধরনের শূর্ণত্য কাজ করে। এটা অনেকটা মনাকপ্সিস এর ধারণা। লেখকের অনুভূতিতে, মানুষ যখন তার বর্তমান অবস্থানে প্রতিনিয়ত কোনো অস্বস্তি নিয়ে বেঁচে থাকে, যখন তার মনে হয় সে অন্য কোনো পরিবেশে, অন্য মানুষের ভিড়ে খুঁজে পাবে তার অধিবাস, তখন এই তীক্ষ্ণ যে অনুভূতি হৃদয় দংশনে সফল, সেই অনুভূতির কোনো নাম বাংলা ভাষায় কি আছে? ইংরেজি ভাষায় কি আছে? প্রচলিত অভিধানে কাছাকাছি শব্দ থাকলেও এই অনুভূতির নাম এখনো কোন অভিধানে নেই, তবে নিওলগিজমের জগতে আছে যা মনাকপ্সিস।
কোন ঘটনায় চুপ থাকাকে আমরা সবসময় দুর্বলতা হিসেবে জানি। কিন্তু এ চুপ থাকার যে একটা পজেটিভ দিক থাকতে পারে তা এ বই থেকে জানতে পেরেছি। লেখকের সাথে যখন তার স্ত্রী-র ডিভোর্স হয় তখন হয়ত তিনি চাইলে নিজেকে রাইট করতে তার সাবেকের ভুল ক্রুটি বলে বেড়াতে পারতেন কিন্ত তিনি তা করেন নি। কারণ- তিনি তার বাচ্চাকে ভালোবাসেন। হয়ত তার সাবেক স্ত্রী, কিন্তু উনি এভাবে না ভেবে চিন্তা করেছেন তার বাচ্চা-র মা। একদিন হয়ত তার বাচ্চা বড়ো হয়ে জানবে ভুল ক্রুটি কার কি ছিলো। কিন্তু তার বাবা তার মা’কে কিংবা তার মা তার বাবা’কে এসব বলেছে। তখন হয়ত তার কাছে খারাপ লাগবে, কারণ- দু’জনেই তার বাবা-মা। অথচ, আামাদের মধ্যে ব্যতিক্রম দেখা যায়, যখনি ডিভোর্স হয় তখনি স্বামী-স্ত্রী ব্যস্ত থাকে একে অপরকে দোষারোপ কিংবা নিজেকে ভালো জাহির করতে।
এই বইয়ের আরেক ইন্টারেস্টিং অনুভূতি একঘেয়েমি।
একটা প্রছন্দের গান কতবার শোনার পরে আর শুনতে ভালে লাগে না? একজন লেখকের কতগুলো বই পড়ার পর মনে হয় যে লেখাগুলো সব একই রকম হয়ে যাচ্ছে? তার লেখাতে নতুন কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। কতবার প্রিয় সেই সমুদ্রসৈকতে ছুটে যাবার পর মনে হয় যে সমুদ্র আর টানছে না? আর কতবার ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসলে জঙ ধরে মনে?
প্রশ্নগুলো যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটা গুরুত্বের সাথে আমরা ভাবি না। এই যে একটা কাঙ্ক্ষিত ব্যাপার হঠাৎ আর কাঙ্ক্ষিত থাকে না; ভালোবাসার কোনো কিছু প্রাপ্তির সীমা ছাড়লে আর কামনার বস্তু থাকে না, এ যে কতটা বিষাদময় তা আমরা বেশির বাগ মানুষই বুঝি। কিন্তু এই একঘেয়েমির অনুভূতিটাতে হার না মানা নিয়ে একবারও ভাবি না।
এ বইয়ের যে কয়টা অনুভূতি সবচেয়ে ভালো লেগেছে তার মধ্যে অন্যতম শাদেনফ্রয়দ। শাদেনফ্রয়দ এটি একটি জার্মান শব্দ। শাদেন অর্থ ক্ষতি আর ফ্রয়দ অর্থ আনন্দ। অর্থাৎ অন্য কারো ক্ষতি সাধন হতে দেখে মনের মাঝে আনন্দের অনুভূতি জেগে ওঠে তখন সেই অনুভূতির নাম শাদেনফ্রয়দ। এ শাদেনফ্রয়দের তীব্রতা আমাদের মাঝে অনেক বেশি। আমরা অন্যর ক্ষতি হতে দেখলে নিজে আনন্দিত হই। কিন্তু ভাবার বিষয় হলো, যার সাথে আমার পরিচয় নাই, চেনা-জানা নাই। আমার ক্ষতিতে সে কোনো খুশি? এমন যদি হতো, তার সাথে ব্যবসয়িক সম্পর্ক জড়িত কিংবা অন্য কোনো কমার্শিয়াল বিষয় জড়িত তার ক্ষতি হলে আমার ভালো হবে সেক্ষেত্রে আনন্দিত হওয়া যায়। কিন্তু যার সাথে সম্পর্ক-ই নাই সে কেন খুশি! এটা আমাদের একটা জাতীয় রোগে পরিণত হয়েছে। লেখকের ভাষায়, যখন দেখি কোনো অভিনেত্রীর দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদের খবর আসে, তখন যে আনন্দের শোরগোল পড়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় পাতায়। আমার তখন বোধগম্য হয় না, কোনকালে এই অভিনেত্রী এত মানুষের ক্ষতি সাধন করল। অথবা কেনই-বা বিশ্বসেরা খেলোয়াড়, যে কিনা পুরো দেশের সম্পদ, তার কোনো ভুলে এত এত মানুষ নেতিবাচক এই অনুভূতির মাতম করতে সদা প্রস্তুত। এর একটাই আর তা হলো সামষ্টিক হীনমন্যতা।
লেখক তার জীবনে ১৭ সালের অভিঙতা থেকে বলেন, যে আমাকে প্রতিযোগি ভাবে, আমার সাফল্য যার কাছে ঈর্ষার কারণ, সেই মানুষ না হয় আমার স্থলনে খুশি হলো, কিন্তু যে মানুষটাকে আমি এত বছর ধরে এতগুলো সুন্দর অনুভূতি উপহার দিলাম আমার গান আর অভিনয়ে, সেও কেন আমার পতনে আনন্দ খুঁজে? এর উত্তরে আবারো বলব- হয়ত আমাদের সামষ্টিক হীনমন্যতা। জাতি হিসেবে আমরা সংকুচিত মনের।
প্রথমদিকে যখন লেখকের খ্যাতি, যশ আসতে শুরু করল। বিভিন্ন জায়গায় কনসার্টের ডাক পরতে লাগল। তরুণ-তরুণীদের মুখে গুণগুণ করে তার গান শোনা যেত। তখন তার ক্যাসেট বিক্রি বাড়লো কিন্তু একটা সময় হয়ত শ্রোতার সংখ্যা বাড়লো কিন্তু ক্যাসেট কিনে গান শোনার শ্রোতা কমে গেল। তার কারণ- পাইরেসি। কপি করে সৃজনশীল কাজ ছড়িয়ে দিচ্ছে সহজে। এখন আপনি হয়ত বলতে পারেন কাজ তো করে সন্মানের জন্য, খ্যাতির জন্য। না, শুধু সন্মানের জন্য যদি কাজ করা হয় তাহলে কাজগুলো করতে যে আর্থিক জোগান লাগে সেটা কত্থকে আসবে? এই পাইরেসি যেকোনো সময় আমাদের একটা ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
বৃহত্তর স্বার্থ বলে একটা কথা আছে। যখন কেউ নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে যেয়ে সঠিক পথটা বেছে নেয় তখন সেই কাজটাই বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনার কাতারে পড়ে যায়। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো কিঞ্চিৎ সংকীর্ণ। কারণ- খুব কম মানুষই আছেন নিজের স্বার্থ বাদ দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থ নিয়ে ভাবেন। এখনে লেখক এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন, তার এক বন্ধু উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। বিভিন্ন উচ্চতর ডিগ্রি শেষ করে মাইক্রোসফটে কাজ শুরু করেন। মাতৃভূমির টানে সে আয়েশি চাকুরি বাদ দিয়ে দেশে এসে গরিব দুস্থ ও পথশিশুদের জন্য গড়ে তোলেন ‘স্পৃহা’ নামে প্রতিষ্ঠান। যে সময়টা তার দামি গাড়িতে সূর্যস্নান করার কথা হাইওয়ে ১০১ এ, সেই সময়টা সে বস্তির গরমে অফিস করছে। প্রতিটি দিন সংগ্রাম করে যাচ্ছে কিছু সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্য। আমরা কতজন মানুষ আছি, যারা এরকম নিজ স্বার্থ ভুলে বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবি!
শেষের দিকে এসে বলব, সবচেয়ে ভালো লেগেছে উনার মাকে নিয়ে একটা অনুভূতি লিখেছেন সেটি। উনার মায়ের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য মায়ের সাথে হজ্জ করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু পিঠে চোটের কারণে তিনি বেশিক্ষণ হাঁটতে পারতেন না, উনার মা জমজম পানি নিয়ে আল্লার কাছে দোয়া করে পিঠে ধুয়ে দিল পরক্ষণেই উনার দীর্ঘদিনের চোট ভালো হয়ে গেল। এ টপিক অনেকটা ইমোশনাল। এ টপিক পড়তে গিয়ে যেকেউ আবেগপ্রবণ হয়ে যাবে।
তাহসান ভাই যে পরিমার্জিত এবং রুচিশীল মানুষ তার ছাপ বইতে পাওয়া গিয়েছে। বিশেষ করে শব্দচয়নে, দারুণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। আরেকটা বিষয়, উনি দেশ বিদেশে পড়াশোনার ফলে নানান ভাষার সাথে পরিচিত। তাই বিভিন্ন অনুভূতি প্রকাশে বিদেশি শব্দ ব্যবহার লক্ষ্য করা গিয়েছে। যেমন- শাদেনফ্রয়দ, মনাকপ্সিস ইত্যাদি। এ শব্দগুলোর সাথে আমরা আগে পরিচিত নই। এ প্রথম পরিচয়। শব্দগুলোর দারুণ ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বইটিতে সবচেয়ে ভালোলাগার দিক হলো লেখক তার অনুভূতি খুব সাদামাটাভাবে তুলে ধরেছেন। আমার কাছে বইয়ের সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ অংশ ছিলো লেখকের বাবার কাছে লেখা চিঠি।
প্রত্যকটা অনুভূতিই আমার কাছে দারুণ লেগেছে। অনুভুতির সাথে যে কবিতাগুলো দিয়েছে এগুলোও খুব ভালো লেগেছে সবশেষ একটি কথাই বলব, ব্যক্তি তাহসানকে এতদিন গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা, উপস্থাপক আর শিক্ষকরুপে দেখেছি এবার সময় হয়েছে লেখক রুপে ফিরে দেখার। আশাকরি তাহসান ভাই এক ‘অনুভূতির অভিধান’ লেখে থেমে যাবেন না। ভবিষ্যতে নতুন মোড়কে শত অনুভূতির অভিধান উপহার দিবেন।