বই রিভিউ ও ডাউনলোড

পদ্মা নদীর মাঝি বই রিভিউ মানিক বন্দোপাধ্যায়

বুক রিভিউ
বইয়ের নামঃ পদ্মা নদীর মাঝি
লেখকঃ মানিক বন্দোপাধ্যায়
ধরণঃ উপন্যাস
মানিক বন্দোপাধ্যায় একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তার প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দোপাধ্যায়। তার রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা,শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম ইত্যাদি।
“পদ্মানদীর মাঝি” তার অনবদ্য রচনা। এটি তার রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পঠিত,আলোচিত এবং একাধিক বিদেশি ভাষায় অনূদিত একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। ১৯৩৬ সালে গ্রন্থাকারে উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতীয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনূদিত হওয়ার গৌরব অর্জন করে এই উপন্যাসটি।
“পদ্মানদীর মাঝি” উপন্যাসের পটভূমি বাংলাদেশের পদ্মার তীরবর্তী বিক্রমপুর-ফরিদপুর অঞ্চল। উপন্যাসে পদ্মার তীরবর্তী কেতুপুর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর মাঝি এবং জেলেদের জীবনালেখ্য বর্ণিত হয়েছে।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং নায়ক কুবের মাঝি। সে পদ্মা নদীতে নৌকা চালায় এবং মাছ ধরে। বিশেষ করে বলতে গেলে সে পদ্মার ইলিশ মাছ ধরে তার জীবিকা নির্বাহ করে। তার সংসারে সে ই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার স্ত্রীর নাম মালা। মালা দেখতে এত সুন্দর না হলেও মোটামুটি সুন্দরী বলা চলে। তবে মালার সবচেয়ে বড় যে খুঁত সেটা হলো সে জন্মগতভাবে পঙ্গু। কিন্তু তবুও কুবের তার স্ত্রীকে ভালোবাসে।
একদম নিম্নবিত্ত থেকেও নিম্ন পর্যায়ের মানুষ সে। তবুও তার মাঝে আছে ভালোবাসা। সে তার শ্যালিকা কপিলার প্রতি প্রেমের টান অনুভব করে। কপিলাকে নিয়ে সে আলাদা সংসার করার স্বপ্ন দেখে।
কপিলা এই উপন্যাসের নায়িকা। সম্পর্কে সে

মালার বোন,কুবের মাঝির শ্যালিকা এবং আরেকজনের স্ত্রী। কিন্তু তার স্বামীর সাথে তার মনের মিল হয় না। সে স্বামীর সংসার ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। আবার বন্যার সময় সে মালার বাড়িতে বেড়াতে আসে।

কপিলা চতুর,চঞ্চল এবং অত্যধিক বুদ্ধিসম্পন্ন মহিলা। সে মালার মতো অসহায় নয়। সে কুবের তার প্রতি টান অনুভব করে এবং সময় পেলেই সে অনুভূতি কে উস্কে দেয়।
আবার তার স্বামী তাকে ফেরত নিতে এলে সে বাধ্য স্ত্রীর মতো শ্বশুরবাড়ি ফিরে যায়।
উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ এবং রহস্যময় চরিত্র হলো,হোসেন মিয়া। সে প্রকৃতপক্ষে কি কাজ করে সে সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি। মানুষ শুধু দেখেছে সহায় সম্বলহীন হোসেন মিয়া আশ্চর্যজনকভাবে হুট করেই যেন অনেক অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে গিয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত হোসেন মিয়া সমুদ্রের বুকে একটি জনমানবহীন দ্বীপ কিনেছে,যার নাম দিয়েছে ময়নাদ্বীপ। সে তার দ্বীপটিতে একটি জনসমাজ গড়তে চায়। তাই বিভিন্ন এলাকার হতদরিদ্র মানুষদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে,কখনো বা বুদ্ধির জালে ফেলে বাধ্য করে সে তাদের ময়নাদ্বীপে নিয়ে যায় এবং সেখানে রেখে আসে।
হোসেন মিয়ার চতুরতার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন সে সুকৌশলে কুবের মাঝিকে চুরির অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেয়। জেল খাটার ভয়ে কুবের মাঝি হোসেন মিয়ার শরণাপন্ন হয়। হোসেন মিয়া তখন তাকে ময়নাদ্বীপে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। কুবের সেখানে যেতে রাজি হলে কপিলাও কুবেরের সাথে যেতে চায়।
পুরো উপন্যাসে কপিলার কুবেরের প্রতি অনুভূতি নিয়ে দ্বিধা থাকলেও এখানে এসে স্পষ্ট হয় কপিলাও কুবেরকে ভালোবাসে এবং কুবেরের মতো সে ও স্বপ্ন দেখে একসাথে সংসার করার। কুবের কপিলাকে ময়নাদ্বীপে নিতে সম্মত হলে তারা রওয়ানা দেয় ময়নাদ্বীপের উদ্দেশ্যে ফেলে রেখে তাদের সমস্ত অতীত।

উপন্যাসে আমার পছন্দের কিছু লাইনঃ

– “জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর,নিরুৎসব,বিষণ্ণ জীবনের স্বাদ।”
– ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে,ভদ্রপল্লীতে,এইখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।
– যে যাহারে ভালোবাসে,সে তাহারে পায় না।
তাছাড়াও উপন্যাসের শেষের দিকে কপিলার কুবেরের প্রতি সেই উক্তি, “আমারে নিবা মাঝি লগে?” অত্যন্ত জনপ্রিয়। এমন কোন মানুষ হয়তো নেই যে এই উক্তিটি জানেনা।
“পদ্মানদীর মাঝি” নিয়ে পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় যা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। এমনকি এখনো আমরা ফেইসবুকে এ চলচ্চিত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন মিমস দেখি।
একাদশ শ্রেণিতে “পদ্মানদীর মাঝি” উপন্যাস আমাদের পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখনই এ উপন্যাস আমার প্রথম পড়া। আবার পড়লাম,আবার নতুন করে মুগ্ধ হলাম।
লেখক অত্যন্ত নিপুণভাবে জেলেপাড়ার সুখ-দুঃখ,দৈনন্দিন জীবনযাত্রা তুলে ধরেছেন উপন্যাসটিতে। পদ্মার ইলিশ আমাদের প্রত্যেকেরই পছন্দের তালিকায় থাকা একটি খাবার। কিন্তু যাদের জন্য এ মাছ আমাদের রান্নাঘর পর্যন্ত আসে সে জেলেরাই কখনো এ মাছ খাওয়ার স্বাদ উপভোগ করতে পারেনা। এটি আজকের সমাজের অত্যন্ত নির্মম একটি চিত্র।
হোসেন মিয়ার মতো মানুষেরা প্রত্যেক সমাজেই বিদ্যমান। আমাদের আশেপাশেই এমন হাজারো হোসেন মিয়াকে পাওয়া যাবে যারা নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অন্যকে বিপদে ফেলতে ন্যূনতম দ্বিধাবোধ করেনা।
আশা করি অনেকেই এ উপন্যাস পড়েছেন।
উপন্যাসটি আপনাদের কাছে কেমন লাগল তা জানানোর অনুরোধ রইল এবং যারা এখনো পড়েন নি,তারা পড়ে দেখতে পারেন। আপনাদের কাছে ভালোই লাগবে উপন্যাসটি এ কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button