জীবনীঃ ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল বই রিভিউ – আবুল হাসনাত কাসিম
বইঃ ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল
লেখকঃ আবুল হাসনাত কাসিম
ব্যাক্তিগত রেটিংঃ- ১০/১০
প্রকাশকঃ সমকালীন প্রকাশনী।
একটা অনুচিন্তন ক্রিয়া করতো মনের মাঝে সব সময় যে এক এক মাজহাব এক এক ইমাম মানে মতাদর্শের এবং যুদ্ধে লিপ্ত থাকা এক এক জন ব্যাক্তি। কিন্তু যখন ইমামদের সম্পর্কে জানতে ইমাম সিরিজ পড়লাম পুরো ধারণায় পরিবর্তন হয়ে গেলো। অবাক করার মতো বিষয় তারা একে অন্যের প্রতিপক্ষ হওয়া তো দূরের কথা তারা ছিলেন একে অন্যের সহযোগী, শুভাকাঙ্ক্ষী।
ইমাম আবু হানিফা নিজের প্রিয় ছাত্রকে পাঠান ইমাম মালিকের কাছে। আবার ইমাম আশ শাফেঈ ছিলেন ইমাম মালিকের ছাত্র। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল ছিলেন ইমাম আশ শাফেঈর ছাত্র। ইমাম আহমাদ চল্লিশ বছর ধরে প্রতিটি সালাতের পর ইমাম শাফেঈ এর জন্য দোয়া করেছেন।। দেখুন কতো সুন্দর একজন আর একজনের মহব্বতের মিশে থাকার গল্প।
ইমামদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ ও কৌতূহল অনেক আগেই থেকে ছিলো। কিন্তু সমসাময়িক তেমন কোন বই খুঁজে পাইনি। কিছুদিন পরই হাতে চলে আসলো সমকালীন প্রকাশনীর কতৃক প্রকাশিত ইমাম সিরিজ। বেশ উৎকন্ঠা আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করলাম। ইমামদের জীবনী গুলো পড়ে যে মুগ্ধ হয়েছি সেই মুগ্ধতা এখনো কমেনি। ফিকহশাস্রে আবু হানিফা,হাদিসশাস্রে ইমাম মালিক, উম্মাহর আকিদা রক্ষায় ইমাম আহমাদ এর যে ত্যাগ কুরবানি যেকোন পাঠক পড়ে পরিতৃপ্ত না হওয়ার কোন উপায় নেই। সবগুলো জীবনী ছিলো অসাধারণ। তবে এই সিরিজে যে জীবনীটি আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তা হলো ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল এর জীবনী।
ইসলামের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে যে কয়জন মনিষী অমর হয়ে থাকবেন তার মধ্যে একজন হচ্ছেন এই ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল। তার চিন্তাধারা গভীরভাবে ঐতিহাসিক বিবর্তন ও আধুনিক চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। এই প্রখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ, আইনবিদ ও হাদিসবিদ হিজরি ১৬৪ সনের ১ রবিউল আউয়াল বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সে বাবা হারান তিনি। তারপরেও থেমে থাকেনি জীবন। ইমাম আহমেদের মনোবল ছিলো অত্যন্ত দৃঢ়। ইমাম, আমল,আখলাক অন্যান্য বিষয়ের মতো আল্লাহভীরুতায়ও ইমাম আহমাদ রাহিমাহল্লাহ ছিলেন অতুলনীয়। খুব বেশি দুনিয়াবিমুখ ;মুত্তাকী এবং বড় আবেদ ছিলেন তিনি। একজন দাতা এবং অতিশয় বুদ্ধিমান দ্বীনের প্রতি ছিলো তার অবাধ বিশ্বাস। হাদিসের জগতে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। সুদক্ষ হাদিসবিশারদ ;হাদিসের দোষ গুণ বিচারশক্তি বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি ছিলো তার নখদর্পনে। তার হাদিস সংকলনের প্রচেষ্টা ছিলো শিক্ষা জীবন সমাপ্তির পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। শিক্ষকতায় তার দারসে একসাথে পাঁচ হাজারেরও বেশি লোক অংশ নিত। ইমাম আহমাদ হচ্ছেন সেই ব্যাক্তি যাকে ৬০ হাজর প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং তিনি হাদদাসনা ও আখবারণা বলে সবগুলোর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সংশয়যুক্ত কোন কাজই তিনি করতেন না এবং কী রাজা-বাদশাহের কাছ থেকে তিনি কোন উপহার গ্রহণ করতেন না। ” তিনি তার চাচা ইসহাক এবং তার পুত্রদের পিছনে সালাত আদায় করতেন না এবং কী কথা ও বলতেনা না। কারণ তারা বাদশাহ এর পক্ষ থেকে পুরষ্কার গ্রহণ করেছিলেন একদিন”। সত্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোষহীন। আহমেদ ইবনে হাম্বল তার সমস্ত জীবনব্যাপী মুতাজিলা(খালক্বে কুরআন) যুক্তিবাদীর মতবাদের বিরোধিতা করেন। সমসাময়িকালের ধর্মীয় নেতারা খলিফার রোষানল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একে একে খলিফার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সমর্থন শুরু করেন ; এবং মুতাজিলা মতবাদকে সমর্থন জানায়। কিন্তু ইমাম আহমাদ এটা মানতে অস্বীকার করন এবং বারবারই মুতাজিলা মতবাদকে ভ্রান্ত বলে ঘোষণা দেন। এর জন্য তাকে নির্মম নির্যাতন ও কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। উম্মাহর আকিদা রক্ষায় একাই লড়াই করেছেন তিনি। জল্লাদের লৌহদন্ডের আঘাত অম্লান বদনে সহ্য করছেন তবুও জালিম শাসকের কাছে মাথা নত করেননি। জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত তিন তার সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন।
খুব সাদামাটা জীবনযাপন করতেন তিনি। দীর্ঘ ৭০ বছর তিনি অভাব অনটনে কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলতেন “পরকালের ভয় আমার খবাারের আগ্রহ নষ্ট করে দিয়েছে। সবকিছু এলোমেলো হয় যায় সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়”।
২৪১ হিজরি রবিউল আউয়াল মাস ১২ তারিখ ৭৭ বছর বয়সে পরকালে পাড়ি জমালেন ইসলামের এই মহামনিষী। দশ লাখেরও বেশি মানুষ তার জানাযায় অংশ নেয়। হাজ্জাজ ইবনু মুহাম্মদ একটা কথা বলেছিলেন তখন ” আহমাদ ইবনু হাম্বল এর জানাযা না পড়ে আমি আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হতেও পছন্দ করি না। চিন্তা করলে অবাক লাগে কতো অজস্র মানুষের ভালোবাসা ছিল এই মহামনীষীর জন্য।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ- প্রতিটি ইমামের জীবনী একটা একটা উপন্যাসের মহানায়ক। এদেশের ইসলাম বুকে রাখা অজস্র পাঠকের কাছে এ জীবনোপন্যাসারে দৃশ্য বা জীবনী গুলো পৌছিয়ে দেওয়ায় যে ভূমিকা সমকালীন প্রকাশনীর রেখেছে তা অনবদ্য।পাতায় পাতায় কলম লিখে যাবে কিন্তু ইমাম দের জীবনীর মহত্ত্ব শেষ হবে না।
তারপরেও লেখক বা সংকলক যে ভুমিকা রেখেছেন তা প্রশংসার দাবিদার। লেখকের বলার ধরণ ছিলো বেশ সরল ও সুন্দর। পড়ার সময় মনে হবে আপনি একটা মজলিসে বসে আছেন আর একটা একটা জীবনী শুনছেন লেখকের জবানীতে। জীবনীগুলো পাঠককে বেশ অনুপ্রাণিত করবে। ব্যাক্তিগত রেকমেন্ড করছি দেশীয় সমকালীন সাহিত্যে এই সিরজটি বেশ প্রয়োজনীয়।
আল্লাহ লেখক, পাঠক এবং এই বইয়ের পিছনে যাদের অজস্র শ্রম রয়েছে সবাইকে কে কবুল করুক এবং এই বইগুলো যেন আমাদের জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করে থাকে এই আশায় রইলো।
ভালোবাসা রইলো সকলের প্রতি।