বই রিভিউ ও ডাউনলোড

মহিষমতি সমীকরণ নাঈম রিভিউ – হোসেন ফারুকী

||বইয়ের নামঃ মহিষমতি সমীকরণ
||লেখকঃ নাঈম হোসেন ফারুকী
||প্রকাশনীঃ প্রান্ত প্রকাশনী
||জঁনরাঃ সায়েন্স ফিকশন
||মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ ৳
||পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১২৮
||ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৭/১০
পূর্ব-কথা: ‘মহিষমতি সমীকরণ’ নবীন বিজ্ঞান-লেখক নাঈম হোসেন ফারুকী’র সায়েন্স ফিকশন-সংকলন গ্রন্থ। ইতোপূর্বে প্রকাশিত ‘বিজ্ঞানে অজ্ঞান’ এবং ‘চা, কফি আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স’ এর পর এটিই লেখকের প্রথম সায়েন্স-ফিকশন বই। এ বছর বইমেলাতে বইটি প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রান্ত প্রকাশনী’ থেকে। বইটিতে স্থান পেয়েছে একটি বড় এবং বারোটি ছোটো কল্পবিজ্ঞান-কাহিনী। বড় কল্পবিজ্ঞান-কাহিনী ‘রহিমার মা’ আবার আটটি উপগল্পে বিভক্ত। ছোটো কল্পকাহিনীগুলোও লেখক তাদের বিষয়বস্তু-বিবেচনায় ‘টেককল্পবিজ্ঞান’,‘রম্যকল্পবিজ্ঞান’,‘ভৌতকল্পবিজ্ঞান’,‘বায়োকল্পবিজ্ঞান’ প্রভৃতি হিসেবে ভাগ করেছেন।
বইয়ের কথা:
“কেমন আছো বাজান? শইল স্বাস্থ্য ভালা তো? খালি তো চাকরি-চাকরি করো, পোলাডার খবর রাখছো একডু?পোলাডা শুকায় একবারে কাডি হইয়া গেসে। পোলাডার কথা ভাইবা এই হরলিক্সের ডিব্বাটা পাঠাইলাম। দুই বেলা খাইতে দিও।
ইতি,
রহিমার মা”
—ব্যস্ত চাকুরে আকবর সাহেবের কাছে হঠাৎ আসে এই উদ্ভট চিঠি,সাথে এক কৌটা হরলিক্স। রহিমার মা নামে তার কোনো চেনা-পরিচিত নেই। তবে কি ভুল করেই এলো চিঠিটা? কিন্তু শুধু একবার না,বারবার ‘রহিমার মা’য়ের কাছ থেকে এরকম চিঠি পেতে লাগলেন আকবর সাহেব; প্রত্যেকবার ভিন্ন ভিন্ন ঠিকানা থেকে,সাথে ঐ এক কৌটা হরলিক্স। সে হরলিক্সের স্বাদও ভিন্নতর, ঢাকনা খুললেই বেলি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পরে চারদিকে। এদিকে আকবর সাহেবের একমাত্র সন্তান রুদ্র খুব খুঁতখুঁতে,কিচ্ছু খেতে চায় না—তার মনে ধরলো এই হরলিক্স। কয়েকদিন হরলিক্স খেয়ে বেশ মোটাতাজা হলো রুদ্র, কিন্তু তার আচরণে দেখা গেলো অদ্ভুত পরিবর্তন। একদিন হঠাৎ নিখোঁজ হলো রুদ্র। একই ব্যাপার ঘটলো হাজার মাইল দূরে পাহাড়ি জঙ্গলে,ফাদার রোজারিও’র দেওয়া বিশেষ হরলিক্স খেয়ে হারিয়ে গেলো অর্বাচিন চাকমা’র ছেলে চঞ্চল এবং তার বন্ধু অনির্বাণ। ওদিকে আরেক গোপন ল্যাবরেটরিতে টন-কে-টন তৈরি হতে থাকলো সেই বিশেষ হরলিক্স। বিশ্বজুড়ে বইতে শুরু করলো ঘোর রহস্যের চোরাস্রোত, তাবৎ পৃথিবীর বড়ো-বড়ো-মাথা’রা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এই রহস্যের কুল-কিনারা করতে; একসময় খুললো সেই রহস্যের দরজা, যার শুরু হয়েছে অন্য কোনো মহাজাগতিক সত্তার হাত

ধরে। এই রোমাঞ্চকর গল্প শেষ হয়েছে পৃথিবী ছেড়ে অনেক দূরে, অনেক অনেক চমক উপহার দিয়ে। তার রেশ অব্যাহত আছে ছোটো গল্পগুলোতেও! সেগুলো না-হয় পাঠকের জন্যেই তোলা থাকলো!

পাঠ-প্রতিক্রিয়া: লেখকের প্লট-পরিকল্পনা বেশ অভিনব। বাংলাদেশে কল্পবিজ্ঞান-জগতের পথিকৃৎ মুহম্মদ জাফর ইকবাল কল্পবিজ্ঞান-কাহিনী রচনা করেছেন প্রচুর, কিন্তু দেখা গেছে বেশ কতোগুলো গল্পের প্লট আসলে একইরকম—সেই ডিসটোপিয়ান পৃথিবী,সাইবর্গ-রোবটদের রাজত্ব,মানবজাতির প্রান্তীয়করণ,সংঘাত এবং শেষে মানবিকতার কাছে যন্ত্রের পরাজয়। পরবর্তীতে তার অনিবার্য-প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে যারা সায়েন্স ফিকশন রচনা করেছেন, তাদের অনেকের মধ্যেও খানিকটা একইরকম প্লট নিয়ে কাজ করার প্রবণতা দেখা গেছে। সেদিক দিয়ে লেখক নাঈম হোসেন ফারুকী’ স্বতন্ত্র এবং অনন্য। তার কল্পকাহিনীর বিষয়বৈচিত্র্য দারুণ আকর্ষণীয়।
উৎকণ্ঠায়-আবেগে-উত্তেজনায় গা-শিউড়ে উঠেছে রহিমার মা‘ পড়তে গিয়ে । দারুণ রোমাঞ্চ অনুভব করেছি কার্ডিয়াক, শ্মশানপুষ্প, পিয়ানো‘ গল্পগুলোতেও। কয়েকটা গল্প বিজ্ঞান থেকে খানিকটা সরে গেছে সমাজ-সমকাল,সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। ‘আরাম চশমা’,‘শনি’ কিংবা নামগল্প ‘মহিষমতি সমীকরণ’ এরকম উল্লেখযোগ্য গল্প । বিজ্ঞান এবং একে ঘিরে দেশ-কাল-সমাজের সামগ্রিক পরিকাঠামো সম্বন্ধে লেখকের প্রচ্ছন্ন মনোভাব খানিকটা বিদ্রূপ,ভর্ৎসনা এবং হতাশার সাথেই উঠে এসেছে এই গল্পগুলোতে‌। ভালো লেগেছে গল্পের শেষে ছোটো করে প্রাসঙ্গিক-বিজ্ঞানটুকু জানিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাও!
সমালোচনা: ‘রহিমার মা’য়ের পর যতোটুকু কাঙ্ক্ষা-প্রত্যাশা ছিলো লেখকের কাছে, পরের গল্পগুলোতে এসে তার সবটা পূরণ হয়েছে বলতে পারি না, বরং কোথাও কোথাও খানিকটা হতাশ’ই হয়েছি। কয়েকটা গল্প পড়ে মনে হয়েছে গল্পগুলো যেনো আরেকটু পরিপক্ব হতে পারতো,অন্তত হওয়ার সুযোগ ছিলো। লেখকের বাক্যগঠন, শব্দের ব্যবহার বেশ পরিণত;তবে চরিত্রের নাম নির্বাচনে কয়েক জায়গায় আরেকটু শ্রুতিমধুর নাম ব্যবহার করা যেতো বোধহয়। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ইংরেজি ব্যবহারে আপত্তি নেই, তবে তার বাইরে ‘ফর্মাল’,‘রেয়ার’,‘টাইপ’—এরকম শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহারই শ্রেয়।
উপসংহার: আমার ব্যক্তিগত মত, লেখকের প্রস্তুতিপর্ব আরেকটু দীর্ঘায়িত হলে আরো ভালো সায়েন্স-ফিকশন হয়তো পেতে পারতাম আমরা। ফিকশন রচনায় তাঁর অনন্যতা এই বইতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, দেখার বিষয় এটাই ভবিষ্যতে তিনি তা কিভাবে ব্যবহার করেন!
লেখকের পরবর্তী বইয়ের জন্য রইলো অনেক শুভকামনা।
হ্যাপি রিডিং 🙂

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button