বই রিভিউ ও ডাউনলোড

শেষের কবিতা পিডিএফ বই রিভিউ

  • গ্রন্থ: শেষের কবিতাPDf
  • রচয়িতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  • ধরন: উপন্যাস
  • প্রকাশক: বিশ্বসাহিত্য ভবন
  • পৃষ্ঠা: ৭৮
  • মূল্য: ৯০

“হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু তা তোমারি দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।”

শেষের কবিতা সারসংক্ষেপ

‘শেষের কবিতা’ রবি ঠাকুর রচিত নর-নারীর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার এক সরল উপাখ্যান। পুরো উপন্যাসের পরতে পরতে কাব্যরস অতি শৈল্পিকভাবে মিশ্রিত থাকায় রবি ঠাকুর সম্ভবত এর নামকরণে ‘কবিতা’ শব্দের ব্যবহার করেছিলেন।

যাইহোক, পরিবর্তনশীল মহাবিশ্বে যে জিনিসটার পরিবর্তন সবচেয়ে দ্রুত এবং অনিবার্য তা হলো মানুষের মন। এই মন আশপাশের বিভিন্ন ঘটনা, জীবন প্রণালি, বইপুস্তক প্রভৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। আবার নারী-পুরষের পারস্পরিক সহজাত আকর্ষণ থেকে একে-অপরের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়াও মানসলোকে মামুলি ঘটনা। সেই মানসলোকের পরিবর্তনকে কেন্দ্র করেই লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘শেষের কবিতা’।

উপন্যাসের প্রধান চার চরিত্র– অমিত, শোভনলাল, লাবণ্য আর কেতকীর মনোজগতের উত্থান-পতন, আকর্ষণ-বিকর্ষণ তথা প্রেম-বিরহই শেষের কবিতার মূল সুর।

শোভনলাল মেধাবী ছাত্র। লাবণ্যর বাবার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। তাদের বাড়িতে আনাগোনার এক পর্যায়ে শোভন নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলে লাবণ্যকে। কিন্তু লাবণ্যর অবহেলায় সে বাধ্য হয় নিজেকে দূরে ঠেলতে।

অন্যদিকে অমিত পাশ্চাত্য ভাবধারার আধুনিক যুবক। লন্ডনে থাকার সময়ে কেতকী তথা কেটির প্রতি দুর্বলতাবশত তাকে আংটি উপহার দেয়। অতঃপর প্রেম যমুনায় নাও ভাসায় দুজনে। কিন্তু অমিত দেশে ফিরে নিজের মধ্যে হঠাৎ আবিষ্কার করে নিবারণ চক্রবর্তী নামে এক কবি সত্তাকে। যে কিনা ফ্যাশনে নয়, স্টাইলে বিশ্বাসী। ব্যাস! সেই নিবারণের প্রভাবে অমিত খুঁজতে শুরু করলো ফ্যাশনের প্রভাববর্জিত স্টাইলি কোন মেয়েকে। অর্থাৎ খাঁটি সংস্কৃতিমনা মেয়ে। দুর্ঘটনাবশত দেখা হয়ে গেল পর্বতসঙ্কুল শিলঙের কোলে নিজেকে প্রকৃতির মায়ায় গড়ে তোলা লাবণ্যকে।

দীর্ঘ দেহী, প্রশস্ত ললাট, ডৌল চিবুক ও শ্যামলবরণের অধিকারী লাবণ্য প্রকৃতির মতই মনোহরিণী। তার এই অনন্য রূপের সঙ্গে যোগ হয়েছে বহু পুস্তকলব্ধ বিকশিত মননের। ফলে মনোরাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর দেখা পেয়ে গেল অমিত। শুরু হলো প্রণয়। শিলঙের সবুজ শ্যামল নির্জন পরিবেশে তাদের প্রেমনদী বয়ে চললো বিচিত্র পথে; শান্ত ধারায়; অপূর্ব ঢঙে। এর মধ্য দিয়ে অমিতের জীবনে কেটি পরিণত হলো বিস্মৃত অতীতে।

এর বহুকাল পর অমিত-লাবণ্যর প্রেমনদীতে আকস্মিকভাবে বিশাল এক যুগোল বান আসলো। সে বানের নাম শোভনলাল ও কেটি। তাতে ভেসে গেল কল্পলোকের গঙ্গার তীরে নির্মিতব্য অমিত-লাবণ্যর মিলনকাব্যের সব ছন্দ। অর্থাৎ প্রণয়নাট্যের ক্লাইমেক্সে এসে অমিত লাবণ্যকে তাঁর এক বন্ধুর গল্প বললো এবং জানালো সে শিলঙে আসছে। নাম তার শোভনলাল। লাবণ্যর মধ্যে জেগে উঠলো অনাদরে অবহেলায় দূরে ঠেলে দেয়া সেই শোভনলালের করুণ মূর্তি। চেষ্টা করেও সে নিজের অন্তরে শোভনলালের উপস্থিতি নিবারণ করতে পারলো না। একদা যে শোভন ছিল সহ্যের অতীত আজ কেন সে মানসলোকে তুফান তুলছে! এক অভূতপূর্ব সঙ্কটে পড়ল লাবণ্য! একদিকে অমিতের চঞ্চল ও সাহিত্যজাত ভালোবাসা অন্যদিকে শোভনের শান্ত, নিভৃত ও সহজাত ভালোবাসা। কাকে রেখে কাকে গ্রহণ করবে! উভয়ই তার মনোজগতের মধুমক্ষিকা। অমিতকে সুযোগ দিলে শোভনের মলিন বদন ফুটে ওঠে, আর শোভনের কাছে গেলে অমিতের সব আয়োজন, সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। আবার এতদিনে অমিতের প্রতি যে অনুরাগ-অনুভূতির জন্ম হয়েছে তাও তো লাবণ্যমনে দেদীপ্যমান!

এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে মঞ্চে আগমন ঘটলো কেটির। বিস্মৃতির আস্তাকুঁড়ে নিভে যাওয়া এক প্রদীপ টেনে আনলো কেটি, যা লাবণ্যর স্পর্শে জ্বলে উঠলো। সে আলোয় লাবণ্যর সম্মুখে প্রকাশিত হলো অক্সফোর্ডের ক্যাম্পাসে বসে রচিত ‘রয়-কেটি’র অপরিপক্ব প্রণয়ের চিত্রনাট্য। মুহূর্তেই সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেল। এতদিন শিলঙে বসে লাবণ্যর মনোজগতে প্রেমের যে সুরম্য প্রাসাদ অমিত নির্মাণ করেছিল তা যেন মুহূর্তের ঘূর্ণিঝড়ে ধ্বসে পড়লো। আহা! পাশে দাঁড়িয়ে থেকেও নিবারণ চক্রবর্তী লাবণ্যর মানসলোকে শুরু হওয়া হৃদয়ঘাতী সে ঝড়ের তাণ্ডব নিবারণ করতে পারলো না।

এতে কার কি লাভ-লোকসান হলো তা জানার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ‘Rolling Stone’ এর মত যাযাবরী অমিতের মধ্যে সংসারবিরাগী যে বাস্তবতা লাবণ্য লক্ষ্য করে তার বুকে নিজেকে সঁপে দিতে ভয় পাচ্ছিল সেই ভয় থেকে মুক্তি পেল। এভাবেই শিলঙের বুকে শুরু হওয়া প্রণয়কাব্যের সমাধি শিলঙেই রচিত হলো।

লাবণ্য শিলঙ ত্যাগ করেছে। ফলে হাহাকার ধ্বনিত হলো পর্বতের অলিতে-গলিতে; লাবণ্যবিরহে শিলঙ যেন হারালো তার সব সৌন্দর্য, সব সজীবতা। হায়! মানবমনের লীলায় বাধ সাধে কে! চির উত্থান-পতনের এ খেলায় জিতে গেল কেটি, জয় হলো শোভনলালের রুধির ধারার মত সুপ্ত ভালোবাসার।
অমিতের ভাবগুরু নিবারণ চক্রবর্তী অমিতকে পাশ্চাত্যের খোলসমুক্ত করে প্রভাতের ন্যায় স্বচ্ছ সৌন্দর্যের অধিকারিণী লাবণ্যের প্রেমসাগরে ডুব দেওয়ালো ঠিকই কিন্তু তারে সে সুধাপানে তৃপ্ত করাতে পারলো না। বেলাশেষে ফ্যাশনের কোলেই ঠাই নিতে হলো অমিতকে। আবার সাত বছরের সাধনায় কেটি যে অমিতকে পেল সে কি দেহ-মনের অমিত ছিল, নাকি কেটি শুধু দৈহিক অমিতকে পেল? এই প্রশ্ন জাগার যথার্থ কারণ সুপ্ত আছে অমিতের ভাষ্যে, “কেতকীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালোবাসারই কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলবে, প্রতিদিন ব্যবহার করবে। আর লাবণ্যের সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা সে রইল দিঘি, সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।”

কল্পলোকবিহারী প্রণয়কে জৈবিক লালসামুক্ত রাখার জন্যই জাগতিক মিলনকে উপেক্ষা করে পত্রমাধ্যমেই বিরহের পথে যাত্রা শুরু করে তারা; অমিত সংসার পাতে কেটির সনে আর লাবণ্য আলোকিত করে শোভনের ঘর। দৈহিক বাস একজনের সঙ্গে আর মানসিক বাস অন্যজনের সঙ্গে। প্রেমের এই নয়া রূপ সৃষ্টিতেই রবি ঠাকুরের মুনশিয়ানা।

নর-নারীর মনোজগতের এ খেলায় কে হারে কে জেতে তা শুধু স্রষ্টাই জানে। জৈবিক চাহিদা, রূপ-লাবণ্য, অর্থ-বিত্ত, ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি মানুষকে প্রেমদরিয়ায় তরী ভাসাতে বাধ্য করে ঠিকই, কিন্তু কূল ধরাতে পারে না! বেলাশেষে সকল অলীক হারিয়ে যায় সত্যের অতলে। এ সত্যই উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়েছে শেষের কবিতায়।

জগতে ভালোর কোন সীমা নেই, ভালোলাগার সময়ও অনির্ধারিত। কখন কার জীবনে কে আসে, অতীত ভালোলাগার প্রাসাদ ভেঙ্গে দিয়ে নয়া প্রণয়ের অট্টালিকা গড়ে তোলে– তা বলা শক্ত।

অমিত-শোভন-লাবণ্যর ত্রিমাত্রিক প্রেমানুভূতির যে সঙ্কট রবি ঠাকুর শেষের কবিতায় অঙ্কন করেছেন, সে ধারায় নর-নারীর অবগাহন আবহমানকাল। লাবণ্যদের ঘিরে এমন শেষের কবিতা প্রতিনিয়তই লেখা হচ্ছে অদৃশ্যফলকের মসৃণ পটে।

মিলনে প্রেম আবেদন হারায়, বিচ্ছেদে লাভ করে অমরত্ব। শেষের কবিতায় রবি ঠাকুর উভয় প্রেমের আখ্যান গেঁথেছেন। অমিত কেটি ও লাবণ্য দুজনকেই ভালোবাসে। দুটো ভালোবাসাই সত্য। পার্থক্য শুধু কল্পলোকের বাসগৃহে দুজনের অবস্থানে; লাবণ্য কল্পলোকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যাকে দিবা-রাত্রে, জনে-বিজনে পূজা দেয় অমিত। অন্যদিকে কেটি তার জাগতিক সঙ্গী, মিলনের আয়োজনে সে ব্যস্ত; তাই অমিতের মনোজগতের একান্ত বাসগৃহে তার জায়গা হয় না।

মনুষ্য জাতির একান্ত জগতে এমন দ্বৈত প্রেমের আধিপত্য সুপ্রাচীন। কালের অতল তলদেশ দিয়ে যা নিরন্তর বয়ে চলেছে। সেজন্যই কবিগুরু হয়তো বলেছেন, “কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও!”

না, মহাবিশ্বের গহবরে বহমান কালযাত্রার ধ্বনি সকলে শুনতে পায় না, কেউ কেউ উপলব্ধি করতে পারে মাত্র।

বিষয়বস্তুর নতুনত্ব, ভাষায় গীতিকাব্যিক মধুরিমা সৃষ্টি, গদ্যের মধ্যে একাধিক কবিতার সুনিপুণ মিশ্রণ, চমকপ্রদ সংলাপ, মনোগ্রাহী বাকচাতুর্য, সর্বোপরি তরুণ-তরুণীদের প্রণয়পীড়িত হৃদয়ের বিশ্লেষণে সত্তরোর্ধ্ব রবি ঠাকুর যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যে আজও বিরল। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, রবি ঠাকুরের জীবনব্যাপী সাধনার কালজয়ী শিল্পের নাম ‘শেষের কবিতা’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button